Wellcome to National Portal
Text size A A A
Color C C C C

সর্ব-শেষ হাল-নাগাদ: ২৮ জানুয়ারি ২০২৩

বাংলাদেশে কোভিড-১৯ কেসসমূহের কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং

ডাঃ নওরোজ আফরিন, আইইডিসিআর

Email: nasoumee@gmail.com

 

‘কেস’ এবং ‘কন্ট্যাক্ট’ ব্যক্তিদের ‘ট্রেসিং’ সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের মূল পদ্ধতি। কোন একটি সংক্রামক রোগে আক্রান্ত, লক্ষণযুক্ত কিংবা লক্ষণবিহীন ব্যক্তিদের বলা হয় ‘কেস’ এবং সেই ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার মাধ্যমে সংক্রামিত হতে পারে এমন মানুষদের বলা হয় ‘কন্ট্যাক্ট’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী ট্রেসিং হল কোন রোগ সংক্রমণের ঝুঁকির মাঝে আছে এমন সব ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা, অবস্থা পর্যালোচনা করা এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার মাধ্যমে রোগ ছড়িয়ে পড়াকে প্রতিহত করা।

কোন সংক্রামক রোগের একটি কেস যখনই শনাক্ত করা হয়, তখনই তার সমস্ত সম্ভাব্য পরিচিতদের বা সংস্পর্শে এসেছে এমন ব্যক্তিদের শনাক্ত করার জন্য অনুসন্ধান করা হয় (নির্দিষ্ট রোগ দ্বারা নির্ধারিত নিয়মে) এবং একটি কন্ট্যাক্ট তালিকা তৈরি করা হয়। ঐ নির্দিষ্ট সংক্রামক রোগের জন্য প্রয়োজনীয় ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা, পোস্ট-এক্সপোজার প্রফাইল্যাক্সিস এবং রোগ ব্যবস্থাপনাসহ, যতবার প্রয়োজন ততবার ফলো-আপ অ্যাকশনের জন্য তাদের সাথে যোগাযোগ করা হয়। প্রারম্ভিক পর্যায়ে কেস এবং কন্ট্যাক্ট খুঁজে বের করার পরে, যাদের এই রোগ নেই, তাদের থেকে এদের আলাদা করা হয়। আলাদা রাখার এই ব্যবস্থাকে কেস-এর জন্য বলা হয় ‘আইসোলেশন’ এবং কন্ট্যাক্ট-এর জন্য বলা হয় 'কোয়ারেন্টাইন'। এইভাবে, রোগের সংক্রমণের বিস্তার পদ্ধতিতে একটি ভাঙ্গন ধরানো সম্ভব, যার ফলে সংক্রমণের বিস্তার হ্রাস পায় এবং সংশ্লিষ্ট মৃত্যু আর অসুস্থতাও কমে আসে। রোগ নিয়ন্ত্রণের পরিমাপ হিসাবে জনস্বাস্থ্যকর্মীরা এই প্রক্রিয়াটি কয়েক দশক ধরে প্রয়োগ করে আসছে। যাইহোক, রোগ সংক্রমণের বিস্তার পদ্ধতিতে ভাঙ্গন ধরানোর জন্য কন্ট্যাক্ট ট্রেসিংয়ের কার্যকারিতা সর্বোচ্চ হয় যখন কেস এর পরিমাণ কম থাকে; আর উল্টোটা হয় যখন জনগোষ্ঠীর মাঝে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে ও কেস-এর পরিমাণ বেশী থাকে।

বাংলাদেশে প্রথম কোভিড-১৯ পজিটিভ কেস শনাক্ত হওয়ার পর দেশের অভ্যন্তরে রোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণ ও প্রশমিত করার লক্ষ্যে, ৮ই মার্চ ২০২০-এ থেকে, ইনস্টিটিউট অফ ইপিডেমিওলজি, ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ (আইইডিসিআর) কেস-এর জন্য আইসোলেশন এবং কন্ট্যাক্টের জন্য কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে কোভিড-১৯ কেস অনুসন্ধান ও কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং (অনুসন্ধান) পরিচালনা করে আসছে।

কোভিড-১৯ কেসগুলির 'কন্ট্যাক্ট' এর অপারেশনাল/প্রায়োগিক সংজ্ঞা এবং আইইডিসিআর এর 'কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং ওয়ার্কফ্লো' (কন্ট্যাক্ট চিহ্নিত করার কর্মধারা)।

একটি নিশ্চিত কোভিড-১৯ কেস শনাক্ত হওয়ার সাথে সাথে আমরা কন্ট্যাক্টদের সন্ধান শুরু করি। প্রথমে সামাজিক-জনতাত্ত্বিক, রোগতাত্ত্বিক, ঝুঁকির কারণ এবং যোগাযোগ সম্পর্কিত তথ্যের জন্য অনুসন্ধান করা হয় এবং আলাদা থাকার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়। আমরা কোভিড-১৯ কন্ট্যাক্ট সংজ্ঞায়িত করি এইভাবে -

ক) যে কোন ব্যক্তি যার সাথে কেস-এর সরাসরি শারীরিক সংস্পর্শ ঘটেছিল (যেমন হাত মেলানো, আলিঙ্গন করা এবং এধরণের অন্যান্য এক্সপোজার)

খ) যে কোন ব্যক্তি যিনি ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম ছাড়াই রোগীর সংক্রামক ক্ষরণের সরাসরি সংস্পর্শে এসেছেন (যেমন গায়ে কফ/কাশি পড়া, গ্লাভস ছাড়া রোগীর ব্যবহৃত টিস্যু পেপার স্পর্শ করা ইত্যাদি)

গ) যে কোনো ব্যক্তি যিনি কেস থেকে আনুমানিক এক মিটারের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচ মিনিটের জন্য ছিলেন (যেমন, মুখোমুখি কথাবার্তা, কাছাকাছি আসনে একসাথে ভ্রমণ করা, প্রার্থনা করা ইত্যাদি)।

কেস থেকে প্রতিটি সম্ভাব্য কন্ট্যাক্টের তথ্য সংগ্রহ করে কন্ট্যাক্টের একটি তালিকা তৈরি করা হয়। তারপর তার সাথে যোগাযোগ করা হয়, অবস্থান এবং অন্যান্য রোগতাত্ত্বিক তথ্যের জন্য চিহ্নিত করা হয় এবং কোয়ারেন্টাইনসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়। কেস-এর সংস্পর্শে আসার দিন থেকে ৭ম এবং ১৪তম দিনে কন্ট্যাক্টকে ফলো-আপ কল করা হয় এবং তাকে তার স্বাস্থ্যের অবস্থা ও কোভিড-১৯ এর লক্ষণগুলির প্রকাশ হলো কি’না সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়। যদি কোনো উপসর্গ দেখা দেয়, তাহলে তাকে কোভিড-১৯ পরীক্ষা করার পরামর্শ দেওয়া হয়। এইভাবে, যে যেসব কন্ট্যাক্ট, কেসে পরিণত হয় তাদের শনাক্ত করা হয়, আইসোলেশনে রেখে দ্রুত চিকিৎসা করা হয়।

এপর্যন্ত (ফেব্রুয়ারী ২০২২) আইইডিসিআর- এর কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং কার্যক্রম এবং চ্যালেঞ্জসমুহ

মহামারীর প্রাথমিক পর্যায়ে, ফিল্ড এপিডেমিওলজি ট্রেনিং প্রোগ্রাম, বাংলাদেশ (এফইটিপি,বি) সহকর্মীবৃন্দ অন্যান্য আইইডিসিআর কর্মকর্তাদের সাথে নিয়ে প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যক্তিগতভাবে কেস ও কন্ট্যাক্টের অনুসন্ধান করেছেন, স্থানীয় প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তায় কেসগুলোর আইসোলেশন এবং কন্ট্যাক্টের কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করেছেন। এই কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের অংশ হিসাবে তারা প্রয়োজনে এলাকা ভিত্তিক নিয়ন্ত্রণকারী (জোনাল কন্টেনমেন্ট) প্রচেষ্টা (যেমন লকডাউন) বাস্তবায়নে সরাসরি জড়িত ছিল। অনেক জেলায় কেস শনাক্ত করার পাশাপাশি কেস-এর সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে, আইইডিসিআর কৌশল পরিবর্তন করে।  'প্রতিটি' কেস অনুসন্ধানের বদলে, গুচ্ছাকারে কেসের অনুসন্ধান এবং খানা পর্যায়ে কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং-এর কাজ শুরু করে। কেস/  কন্ট্যাক্টদের আইসোলেশন/কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করার অংশ হিসেবে, তারা প্রয়োজনানুসারে এলাকা ভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টায় সহযোগিতা অব্যাহত রাখে। যাইহোক, যখন রোগটি সকল জেলায় ছড়িয়ে পড়ে, তখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রযুক্তিগত সহায়তায় আইইডিসিআর জেলা ও উপজেলা স্তরে কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং-এর সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য, মোট ৭২৩ জন ডাক্তার এবং ১৭১৫ জন নন-মেডিকেল কর্মীদের (স্বাস্থ্য কর্মী নয়) প্রশিক্ষণ দেয়।

এছাড়াও, আইইডিসিআর এই উদ্দেশ্যে জেলা স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং নির্দেশনা প্রদান অব্যাহত রাখে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মানবসম্পদ (জাতীয় সমন্বয়কারী, প্রাদুর্ভাব তদন্ত কর্মকর্তা, অনুজীব বিশেষজ্ঞ, যোগাযোগকর্মী, গণনাকারী, উপাত্ত ব্যবস্থাপনা সহকারী এবং স্বাস্থ্যপ্রযুক্তিবিদ) বৃদ্ধির পাশাপাশি কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং-এর সহজলভ্যতা ও ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে যানবাহন, মোবাইল ফোনে যোগাযোগের জন্য প্রয়োজনীয় টক-টাইম এবং গো ডেটা সফ্টওয়্যারগুলি চালাতে সহায়তা চালিয়ে যাচ্ছে। রবি-আজিয়াটা নামের একটি টেলিকম অপারেটরও, ওভার-ফোন কন্ট্যাক্ট ট্রেসিংয়ের জন্য টক-টাইমের চ্যালেঞ্জগুলি কাটিয়ে উঠতে সহায়তা প্রদান করেছে। পাশাপাশি অন্যান্য দাতা সংস্থারও (যেমন ইউএসএইড, ব্র্যাক, এফএও ইত্যাদি) অবদান ছিল।

জনগোষ্ঠীর মাঝে সংক্রমণ ছড়াতে থাকা এবং কেস-এর আধিক্য থাকা অবস্থায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী আইইডিসিআর, লক্ষ্যভিত্তিক কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং এর বিষয়টি আলোচনায় আনে, যেমন, সক্ষমতার উপর ভিত্তি করে উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা কন্ট্যাক্টদের অগ্রাধিকার দেয়া। কিন্তু, বিভাগীয়, জেলা এবং উপ-জেলা পর্যায়ে প্রশাসনিক সংস্থাগুলি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মহামারী সংক্রান্ত সহায়তা প্রদান এবং শুধুমাত্র উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা কন্ট্যাক্টদের ট্রেসিং করতে প্রস্তুত ছিল না। পাশাপাশি উপচে পড়া রোগীদের সেবা দেয়াও এর সাথে চলমান ছিল। বর্তমানে আইইডিসিআর-এর মাত্র ১৩জন কর্মী কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং এর সাথে যুক্ত আছে। উন্নয়ন সহযোগীদের পক্ষ থেকে নিরবচ্ছিন্ন মানবসম্পদ, রসদ সরবরাহ এবং আর্থিক সহায়তা ছাড়া সল্প মাত্রায় সংক্রমণের সময় দূরে থাক, সংক্রমণের মাত্রা যখন অধিক থাকে তখনই উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা কন্ট্যাক্টদের অগ্রাধিকার দিয়ে লক্ষ্যভিত্তিক কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং পরিচালনা করা প্রতিষ্ঠানটির জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়ায়। জনস্বাস্থ্য বিষয়ক সামাজিক বিধি সহ কেস/কন্ট্যাক্ট-এর আইসোলেশন/  কোয়ারেন্টাইন বজায় রাখতে অনীহা, তথ্য প্রদানে কন্ট্যাক্ট-এর সহযোগিতার অভাবও বাংলাদেশে কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং-এর চ্যালেঞ্জগুলির অন্তর্ভুক্ত।

সাফল্য গাঁথা

কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং, জনস্বাস্থ্য বিষয়ক সামাজিক বিধি এবং এসবের প্রতি জনগণের অনুবর্তিতা বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এর প্রথম ঢেউ ভালোভাবেই সামাল দিয়েছে। যাইহোক, সময়ের সাথে সাথে ভাইরাসের নতুন আরও কিছু সংক্রামক ধরণ বা স্ট্রেইনের উত্থান এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থা মেনে চলতে কিছু মানুষের অনিচ্ছার কারণে, দেশের জনগোষ্ঠীর মাঝে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে বলে কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং-এর উদ্দেশ্য পূরণ খানিকটা অফলপ্রসূ হয়ে পড়ে। তবুও, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিংয়ের জন্য স্থানীয় সক্ষমতা বিকাশ, এই জাতীয় স্থানীয় কার্যক্রমকে চালিয়ে নেবার জন্য কেন্দ্র থেকে কর্মীদের মানোয়ন্নয়ন এবং কন্ট্যাক্ট ট্রেসিংএর কার্যকরী বাস্তবায়নের জন্য অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সাথে যৌথ কর্মদ্যোগ সত্যিই আরেকটি সাফল্য হিসাবে বিবেচিত হতে পারে।

শেষ কথা

অন্যান্য দেশের মতো, বাংলাদেশেও সংক্রামক রোগের বিস্তার কমাতে কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, বিশেষ করে যখন কেস-এর সংখ্যা কম থাকে, অবশ্য উচ্চমাত্রায় রোগ সংক্রমণের ক্ষেত্রে এমনকি উন্নত পদ্ধতি প্রয়োগের পরেও, এটি খুব বেশি কার্যকর হয়নি। যাইহোক, প্রেক্ষাপট যাই থাকুক না কেন, সমস্ত নীতি নির্ধারকদের পক্ষ থেকে ভাল সহযোগিতা ছাড়া, একটি প্রাদুর্ভাব বা মহামারী নিয়ন্ত্রণ বা প্রশমনের জন্য আইসোলেশন এবং কোয়ারেন্টাইনের সাথে কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা কার্যত একটি চ্যালেঞ্জই রয়ে যাবে।