ডা. জিয়াউল মতিন, ডা. সামিনা শারমিন, ইউনিসেফ
বাংলাদেশের লাখো মানুষের মাঝে সংক্রমণ ও হাজারো মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়া ছিল কোভিড-১৯ এর তাৎক্ষণিক প্রভাব। এই অতিমারী সবচেয়ে ভয়ানকভাবে আক্রমণ করেছে দরিদ্রতম ও দুর্বলতম জনগোষ্ঠীকে। বাংলাদেশে সংক্রমণের প্রথম কয়েক মাসে স্বাস্থ্যসেবা অধিগমন ও ব্যবহারের হার আশঙ্কাজনক ভাবে কমে গিয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ২০১৯ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসের তুলনায় ২০২০ সালের একই সময়ে গর্ভকালীন সেবা গ্রহণের হার ৪১% কমে গিয়েছিল। একইভাবে ২০২০ সালের এপ্রিল-মে মাসে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের হার ২০১৯ এর একই সময়ের তুলনায় ৩১% কমে গিয়েছিল। নবজাতক ইউনিটগুলোতে ভর্তির হারও যথেষ্ট কমে গিয়েছিল।
যুক্তরাজ্যের বৈদেশিক, কমনওয়েলথ এবং উন্নয়নমূলক কার্যালয় (এফসিডিও) এর সহায়তায় ইউনিসেফ নারী ও মেয়েদের কোভিড-১৯ কালীন দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থায় সাড়া প্রদান করে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য ক্লিনিকগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান বজায় রাখতে কাজ শুরু করে, পাশাপাশি জরুরী সরবরাহ যেমন, অক্সিজেন এর যোগান দিতে শুরু করে।
২০২০ সালের এপ্রিলে ইউনিসেফ বাংলাদেশের অক্সিজেন ব্যবস্থার একটি মানচিত্র প্রণয়ন করে। এখানে দেখা যায় (ভরম-১) লাল চিহ্নিত এলাকাগুলো হল কোভিড-১৯ দ্বারা সবচাইতে সংক্রমিত এলাকা এবং এর উপকেন্দ্র হলো ঠিক মাঝ বরাবর “ঢাকা”। বৃত্তাকার চিহ্নিত এলাকাগুলো বোঝাচ্ছে সেখানে অন্ততপক্ষে শহরের একটি হাসপাতালে অক্সিজেন প্লান্ট বা তরল অক্সিজেনের সরবরাহ রয়েছে। লাল চিহ্নিত এলাকাগুলোতে দেখা যায়, অনেক জেলার হাসপাতালগুলোর অক্সিজেন নলও ছিলনা। এই হাসপাতালগুলো যেসব কোভিড-১৯ রোগীর অক্সিজেন প্রয়োজন ছিল তাদের ভর্তি করতে অপারগ ছিল।
এই অতিমারীর প্রভাব নিরসনে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তর, ইউনিসেফসহ অন্যান্য অংশীজনের সহায়তার, কোভিড-১৯ এর সেবা, তৎপরতা ও প্রস্তুতির বিষয়ে একটি পরিমাপ যাচাই করে। এই যাচাইটি করা হয় ২০২০ সালের জুন ও জুলাই মাসে ১২০টি স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রে যেখানে ৮টি বিভাগের বিশেষায়িত মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, এনজিও ও ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
কোভিড-১৯ এর ব্যবস্থাপনায় জটিল অবস্থা সামাল দেয়াসহ প্রয়োজনীয় সরবরাহের যোগান দেয়ার বিষয়টি এই প্রতিবেদনে উঠে আসে। অনেকগুলো বিষয়ের মধ্যে দেখা যায়, ৭০% কেন্দ্রে অক্সিজেন প্লান্ট বা তরল অক্সিজেনের ব্যবস্থা সহ প্রয়োজনীয় অক্সিজেন অবকাঠামো ছিল না এবং অন্যান্য জরুরী অক্সিজেন যন্ত্রপাতি যেমন অক্সিজেন ঘনীকারক ও পালস অক্সিমিটার যা দিয়ে রক্তে অক্সিজেনের উপস্থিতির মাত্রা পরিমাপ করা হয়, সেগুলোও ছিল না।
সবচাইতে জটিল এবং সংকটাপন্ন কোভিড রোগীর উচ্চক্ষমতার বা হাই ফ্লো অক্সিজেন সরবরাহের প্রয়োজন হয়। এমতাবস্থায় সকল জেলা বিভাগ ও সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা প্রাপ্ত (টারশিয়ারী) হাসপাতালগুলোতে যখন রোগীর ব্যবস্থাপনা করা হয় তখন তাদের অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থায় হাই ফ্লো ও উচ্চতম ক্ষমতার অক্সিজেন সরবরাহের সক্ষমতা প্রয়োজন এবং ব্যাকআপ হিসেবে যথেষ্ট পরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহকারী পাইপলাইন, ঘনীকারক এবং সিলিন্ডারের প্রয়োজন। বাংলাদেশের অধিকাংশ হাসপাতালে মাতৃত্বকালীন, শিশু ও নবজাতক ইউনিটে অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা নেই বলে নারী, নবজাতক ও শিশুদের সংকটাপন্ন ও প্রয়োজনীয় সেবা ব্যবস্থা ব্যাহত হচ্ছে।
এই নতুন উদ্যোগটি দ্বারা বাংলাদেশের প্রতিবেদ ও প্রস্তুতিমূলক পরিকল্পনার (বিপিআরপি) অবকাঠামোর মাধ্যমে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ন্যাশনাল ইলেক্ট্রো মেডিকেল ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স, ওয়ার্কশপ এন্ড ট্রেনিং সেন্টার, পূর্ত বিভাগ, স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর এবং অন্যান্য যেসকল সংশ্লিষ্ট এজেন্সি রয়েছে তাদের সঙ্গে আলোচনা ও সহযোগিতার মাধ্যমে ইউনিসেফ, বিশেষায়িত হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা হাসপাতালসহ ৩০টি হাসপাতালে পাইপলাইন সম্প্রসারণ ও গ্যাস আউটলেট স্থাপনে নতুন করে লিকুইড মেডিকেল অক্সিজেন সিস্টেম স্থাপন বা বিদ্যমান সিস্টেমগুলোকে শক্তিশালীকরণের কাজ করেছে। ইউনিসেফ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে আরও সহযোগিতা করেছে কৌশলগতক্ষেত্রে বিভিন্ন স্তরের ঝুঁকি পরিমাপ করে সে অনুযায়ী হাইপোক্সিয়া ম্যানেজমেন্ট এর জন্য অক্সিজেন সরঞ্জাম যেমন অক্সিজেন ঘনীকারক, ভেন্টিলেটর, পালস অক্সিমিটার ইত্যাদি ক্রয়ের ব্যাপারে। এই উদ্যোগটির মূল লক্ষ্য কেবল কভিড-১৯ মোকাবেলা নয় বরং অনেকগুলো হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি করা যাতে মা ও শিশু স্বাস্থ্যের আরও ভাল সেবা দেয়া যায়। এটি করাই হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসরণ করে প্রস্তুতিমূলক কাজে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে। বিগত ৬ মাসে ইউনিসেফ ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামাদিসহ সংকট ব্যবস্থাপনায় অক্সিজেন মেডিকেল সামগ্রীসহ কোভিড-১৯ এ জীবনরক্ষাকারী প্রায় ১২২.৮ লক্ষ মার্কিন ডলারের সামগ্রী কিনেছে, যা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সম্মুখসারীর সেবাদানকারীদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা এবং অতিমারীর সংকটাপন্ন মুহূর্তে রোগী ব্যবস্থাপনার উন্নতি নিশ্চিত করেছে।
জেলা হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কম ওজনের ও অসুস্থ নবজাতকের যত্ন নেয়ার জন্য ইউনিসেফ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে নবজাতকের বিশেষায়িত যত্ন ইউনিট (স্ক্যানু) স্থাপনার জন্যও সহযোগিতা করছে। এখন পর্যন্ত ৪২টি জেলায় উচ্চ হারে শয্যার সংখ্যা পূর্ণ থাকলেও অক্সিজেন ব্যবস্থাপনায় কম দক্ষ কর্মী সম্পন্ন ৪৮টি স্ক্যানু রয়েছে। এসব স্ক্যানু পরিচালনা করতে এবং ব্যবস্থাপনার মান উন্নয়নের জন্য সক্ষমতা বৃদ্ধিতে আরও সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে।
বাংলাদেশে নবজাতকের নিবিড় পরিচর্যার আরেকটি অবহেলিত দিক হলো রেটিনোপ্যাথি অব প্রিম্যাচিওরিটি বা প্রাকপূর্ণতার কারণে চোখের রেটিনার প্রদাহ (আরওপি) যেটি শিশুদের অন্ধত্বের প্রধানতম কারণ হিসেবে মাথা তুলছে। এর পেছনেও কারণ হলো সময়ের আগে জন্ম নেয়া ও কম ওজনের শিশুদের সাপ্লিমেন্টাল অক্সিজেনের বিষয়ে নজরদারির অভাব এবং প্রাকপরিপূর্ণতাপ্রাপ্ত শিশুদের যথাযথ পর্যবেক্ষণের ঘাটতি।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে নিউমোনিয়া আক্রান্ত পাঁচ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে ১৩.৩ শতাংশই অক্সিজেনের অভাবে ভোগে অর্থাৎ হাইপোক্সিক। এটি দ্রুত চিহ্নিত করা গেলে এবং অক্সিজেন থেরাপি দেয়া হলে পরবর্তীতে এসব শিশুদের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। ভুল মাত্রায় অক্সিজেন থেরাপি অক্সিজেনের অসংগত ব্যবহারেও নবজাতক, বিশেষ করে আগে আগে জন্ম নেয়া নবজাতকের হাইপোক্সিয়া বা হাইপোক্সেমিয়া ব্যবস্থাপনায় আরও জটিলতর অবস্থা ডেকে আনে যেমন, আরওপি, ফুসফুস ও মস্তিষ্কের ক্ষতি ইত্যাদি।
ইউনিসেফের এই উদ্যোগটি শিশু এবং ছোট ও অসুস্থ নবজাতকের মানসম্মত সেবা দানের জন্য কৌশলপত্র ও দক্ষতা উন্নয়নে পালস অক্সিমিটার দ্বারা অক্সিজেন স্যাচুরেশনের সঠিক অবস্থা চিহ্নিতকরণ ও শিশুদের স্বাস্থ্য সেবায় সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পাইপলাইনের মাধ্যমে অক্সিজেন ঘনীকরণ যন্ত্র বা সিপিপি সাহায্যপুষ্ট সিলিন্ডার এর মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ করার মধ্য দিয়ে হাইপোক্সিয়া ব্যবস্থাপনার জন্য দশটি জেলা ভোলা, বরগুনা, বগুড়া, চট্টগ্রাম, গাইবান্ধা, কিশোরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, শেরপুর, খাগড়াছড়ি ও টাঙ্গাইলের ৬৪টি সেবাকেন্দ্রে যেমনটা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফ মানসম্মত সেবা দানের ক্ষেত্রে দেখতে চায় সেটা অর্জন করতে সহায়তা করবে। এছাড়াও এটি অক্সিজেন সরঞ্জামাদি স্থাপন ও বিনিয়োগে নিরাপদ অক্সিজেন সরবরাহে সাহায্য করবে যার ফলে হাইপোক্সেমিয়া, অন্ধত্ব অথবা মস্তিষ্কের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হবার কারণে নবজাতক ও শিশু মৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে সাহায্য করবে।