Wellcome to National Portal
Text size A A A
Color C C C C

সর্ব-শেষ হাল-নাগাদ: ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে আমাদের শিশুদের ক্ষমতায়ন

কাজি মুনিসুল ইসলাম, আইসিডিডিআরবি; অপর্ণা বিশ্বাস, ডিজিএইচএস; ইকবাল আনসারী খান, আইইডিসিআর

Author Email: munisul@icddrb.org

 

 

মুল বার্তা

১৫ থেকে ১৮ বছরের মাঝে বিয়ে হয়ে যাওয়া মেয়েদের অনুপাতের দিক থেকে বাংলাদেশ শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর অন্যতম। বাল্যবিবাহের কারণে নববধু এবং তাদের ভবিষ্যৎ সন্তানেরা স্বাস্থ্য ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে নানামুখী নেতিবাচক পরিণতির শিকার হয়। বিশ্ব ব্যাংকের হিসেব বলছে বাল্যবিবাহ সম্পূর্ণ নির্মূল করা গেলে জাতীয় অর্থনীতিতে বাড়তি ৪০,৩২০ কোটি টাকা যোগ করা যেত যা জাতীয় বাজেটের প্রায় ১০ শতাংশ।

সমস্যার বিবরণ

আঠারো বছরের আগে বিয়ে হওয়াকে বাল্যবিবাহ বলে। বিশ্বে প্রতি ৫ জনের একজন মেয়ে শিশু এর শিকার যা বিশ্বজুড়ে প্রতি মিনিটে ২৩টি বালিকার বাল্যবিবাহজনিত বিপদ সংকেত দিচ্ছে। এই হার বাংলাদেশে আরও উর্দ্ধগামী, এখানে ৫৯% এরও বেশি বালিকার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে ১৮ এর আগে আর ২৯% ১৫ এর আগে। এই হার বিশ্বে বাংলাদেশকে ১৮ বছরের আগে বিয়ে’র হিসেবে ‘চতুর্থ’ এবং ১৫ বছরের আগে বিয়ে’র  হিসেবে ‘প্রথম’ স্থানে পৌঁছে দিয়েছে। দাম্পত্য নির্যাতন, মাতৃমৃত্যু ও শিশু মৃত্যুর সাথে বাল্যবিবাহ গভীরভাবে সম্পর্কিত। সমাজে ব্যাপক প্রভাব বিস্তারকারী বিষয় যেমন, শিক্ষার হার হ্রাস এবং দারিদ্র ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি, (অপরিকল্পিত গর্ভধারণ, অল্প বয়সে প্রথম সন্তান প্রসব এবং পরিবারের কলেবর বৃদ্ধির কারণ) - বাল্যবিবাহেরই কুফল।

১৯২৯ সাল থেকে বাল্যবিবাহ বাংলাদেশে অবৈধ। আইনী মতে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ ও ছেলেদের ২১ বছর। গত ২৫ বছর ধরে ১৮-এর নীচে মেয়েদের বিয়ের হার গ্রামাঞ্চলে ৮৬% থেকে কমে ৭১% এবং শহরাঞ্চলে ৭৬% থেকে কমে ৫১% হয়েছে। তারপরও বাল্যবিবাহের হার অনেক বেশী। এই ত্রুটিগুলো কাটিয়ে উঠার উদ্দেশ্যে কিছু নতুন আইন প্রয়োগ করা হয়েছে। ২০০৪ সালে জন্মনিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে যাতে বিয়ের সময় কিছুটা হলেও বয়স যাচাই করা যায়। তবে, ২০১৭ সালে ‘বাল্যবিবাহ দমন আইন’ দ্বারা ১৯২৯ সালের আইন প্রতিস্থাপন করা হয়, যেখানে দোষীদের শাস্তিমূলক জরিমানা বৃদ্ধি এবং বিশেষ করে ‘ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র বিশেষে’ একটি ছেলে বা মেয়ের বিধিবদ্ধ বয়সের আগেই বিয়ের বিধান রাখা হয়। এই ‘ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রের’ সঠিক সংজ্ঞা না থাকায় এই আইনে অপব্যবহারের মাধ্যমে বাল্যবিবাহের হার খুব একটা না কমার শঙ্কা থেকেই যায়।

কেন এই বাল্যবিবাহ?

দারিদ্র, নিরক্ষরতা, নিরাপত্তার অভাব এবং গভীরে গ্রথিত সামাজিক রীতিনীতি একটি মেয়ে শিশুর পিতামাতাকে তার ১৮ বছর পূর্ণ হবার আগেই বিয়ে দিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিতে নানাভাবে প্রভাবিত করে। বাল্যবিবাহ এবং অল্প বয়সে সন্তান জন্মদানের সাথে সম্পৃক্ত নেতিবাচক পরিণতি বিষয়ে শিশু ও তাদের বাবা মায়েরা অনবহিত থাকতে পারেন। একটি পরিচিত সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা যায় কোভিড-১৯ কালে বাল্যবিবাহ ৭১ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে।

বর্তমান নীতি ও এর প্রভাব

যে নীতিটি প্রস্তাব করা হয়েছে - “বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে আমাদের শিশুদের ক্ষমতায়ন”-বাংলাদেশের সকল পঞ্চম শ্রেণী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে একটি বার্ষিক শিক্ষা প্রচারণার উদ্যোগ নেয়ার পাশাপাশি বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সামগ্রিক তথ্য সন্নিবেশিত একটি অধ্যায় পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা।

পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে একটি সমন্বিত বার্ষিক স্কুল-শিক্ষা কার্যক্রম প্রণয়নের প্রস্তাব করা হয়েছে যা-

- ১,৬৪,৭৬৮ টি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করতে পারে এবং

- এতে খরচ হবে মাত্র ৩৫০০ টাকা (প্রতিটি রোধকৃত বিবাহ পিছু)

আশা করা হচ্ছে প্রস্তাবিত শিক্ষা প্রচারণা থেকে ৩১% বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা যাবে।

আয় ব্যয় সংক্রান্ত প্রভাব

এই শিক্ষা প্রচারণার প্রক্ষিপ্ত ব্যয় দেখান হয়েছে ৫৮,০৭,৫৮,৭০০/- টাকা (৬.৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)।

এই কার্যক্রম পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়িত হবে, প্রথমে ‘টিওটি’ বা মূল প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। তারপর জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে, যারা তাদের নিজেদের পারিষদিক পর্যায়ে প্রশিক্ষণ দেবে। স্কুলে প্রশিক্ষণের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে প্রতি বছর ৪৬ কোটি টাকা (৫.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)।

অন্যান্য খরচ ধরা হয়েছে প্রশিক্ষকদের মাঝে প্রচারণা ও প্রশিক্ষণের জন্য। প্রাথমিক কিছু ব্যয় আছে যা এককালীন ব্যয় হিসেবে কার্যক্রমের শুরুতেই খরচ হয়ে যাবে। পরবর্তী ২ বছরে তা কমে আসবে।

অর্থনৈতিক প্রভাব

উপরোক্ত আলোচনা এবং অন্যান্য দেশের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দেখা গিয়েছে, একই ধরণের শিক্ষা কার্যক্রম কাঙ্খিত জনগোষ্ঠীর মাঝে বাল্যবিবাহের হার শতকরা ৩১ ভাগ কমিয়ে আনতে পেরেছে।

এটাও মনে রাখতে হবে কাঙ্খিত পুরো জনগোষ্ঠীর মাঝে সুফল অনুধাবন করতে ৬-৭ বছর সময় লাগবে যতদিন না এই শিশুরা ১৮ বছর পূর্ণ করে।

জনস্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব

যেহেতু বাল্যবিবাহ স্বাস্থ্যের বিবিধ ক্ষতিকারক বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত, বিশেষ করে নতুন বধু এবং তার ভবিষ্যৎ সন্তানের স্বাস্থ্যের সাথে, তাই আমরা অনুমান করতে পারি যে এই কার্যক্রমটি বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের নিম্নবর্ণিত খাতগুলোতে বাল্যবিবাহ সংক্রান্ত সমস্যাগুলোর বিস্তার কমিয়ে আনতে পারবে (টেবিল)।

স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব

প্রাপ্তবয়স্কের বিবাহ বনাম বাল্যবিবাহের ঝুঁকি

অপরিকল্পিত গর্ভধারণ

২১% বেশী

অনিচ্ছাকৃত গর্ভাবসান

১৬% বেশী

পরিবারে সন্তান সংখ্যা ৩ এর বেশী

৩.৯ গুণ

জন্মের সময় কম ওজনের শিশু

৩৩-৫৫% বেশী

মাতৃমৃত্যু

৫ গুণ বেশী(১০-১৪ বছরে বিয়ে)

২ গুণ বেশী (১৫-১৯ বছরে বিয়ে)

 

স্বাস্থ্যের অন্য খাতগুলোতেও ইতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হবে যেমন নবজাতকের মৃত্যু, পারিবারিক নির্যাতন এবং অন্যান্য ‘গর্ভধারণ ও প্রসব সংক্রান্ত জটিলতা’ যা উপরের ছকে উল্লেখ করা হয়নি।

সম্ভাব্যতা

এই কার্যক্রম পরিচালনার সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল কারণ একই ধরণের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ইতোমধ্যেই স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে চালু রয়েছে। বাল্যবিবাহের বিরোধিতাকারী তথ্যসমূহ খুব সহজেই অন্যান্য বিদ্যমান কার্যক্রমের সাথে একীভূত করে দেয়া সম্ভব যাতে উদ্দিষ্ট জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়া যায়।

রাজনৈতিক/রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও এই কার্যক্রমের সম্ভাবনা উজ্জ্বল কারণ- বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সদ্যপ্রণীত আইন, বাল্যবিবাহ সমস্যার প্রতি নতুন করে সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। তার উপরে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের মোট ব্যয় এবং প্রতিটি প্রতিরোধকৃত বিয়ের ব্যয় জাতীয় বাজেটে সংকুলান করা তেমন কঠিন ব্যাপার হবেনা।

সুপারিশ সমূহ

বাল্যবিবাহ একটি বহুমুখী সমস্যা যার শেকড় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের অনেক গভীরে। একারণেই আমরা যে কার্যক্রমের সুপারিশ করছি তা পুরোপুরিভাবে বাংলাদেশ থেকে বাল্যবিবাহ নির্মূল করতে পারবে বলে আশা করা যায় না। তদুপরি, সরকারী-বেসরকারী এনজিও এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানসমূহের চলমান কার্যক্রমসমূহের সাথে একত্রিত ভাবে একটি বৃহৎ-বিস্তৃত-সমন্বিত কর্মসূচী যেমনটা আমরা প্রস্তাব করছি, অবশ্যই বর্তমান পরিস্থিতির উন্নয়ন সাধনে সমাদৃত হবে।