ডা. রাবেয়া সুলতানা, আইইডিসিআর
রোগতত্ত্ব নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এর কীটতত্ত্ব বিভাগের একটি গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। এই বিভাগটি তৎকালীন পাকিস্তানের ম্যালেরিয়া ইনস্টিটিউট পরে বাংলাদেশের ম্যালেরিয়া ইনস্টিটিউটের তিনটি বিভাগের (কীটতত্ত্ব, পরজীবীবিদ্যা এবং কীটনাশক) একটি। এই ম্যালেরিয়া ইনস্টিটিউটটি ভারতের বিখ্যাত ম্যালেরিয়া ইনস্টিটিউটের একটি অংশ যা ১৯০০ সালে একটি কেন্দ্রীয় ম্যালেরিয়া ব্যুরো হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি অর্জন করেছিল। ম্যালেরিয়া ইনস্টিটিউট ভারতে ম্যালেরিওলজি গবেষণা এবং প্রশিক্ষণের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দেশ ভাগের পর, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে 'ম্যালেরিয়ার প্রকোপ' অনেক বেশি থাকায় এর একটি অংশ ১৯৪৭ সালে করাচি এবং পরে আরেকটি অংশ ১৯৫২ সালে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। এই ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম প্রথমে পুরান ঢাকায় শুরু হয় এবং পরে মহাখালীতে বর্তমান স্থানে স্থানান্তরিত হয়। ইনস্টিটিউটের কার্যক্রমের মাঝে ম্যালেরিয়া সম্পর্কিত সকল বিষয়ে স্বাস্থ্য বিভাগকে পরামর্শ দেওয়া যেমন সমীক্ষা, মহামারী সংক্রান্ত তদন্ত, পদ্ধতিগত গবেষণা যার মধ্যে মৌলিক কারণসমূহ যেমন ম্যালেরিয়া সংক্রমণ, বিস্তার, ঘটনা, ভেক্টর বায়োনোমিক্স, কীটনাশকের প্রতি সংবেদনশীলতা এবং স্বাস্থ্য কর্মীদের সংশ্লিষ্ট সমস্ত বিষয় সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ দেওয়া অন্তর্ভুক্ত ছিল।
১৯৬০ সালে, স্বাস্থ্য বিভাগ ভার্টিকাল (দ্রুততম উপায়ে সর্বস্তরে) ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচি (এমইপি ১৯৬১-১৯৭১) শুরু করে। ১৯৬১ সাল থেকে, ইনস্টিটিউটটি তার স্বাভাবিক কার্যক্রমের সাথে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ম্যালেরিয়া নির্মূল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (এম ই টি সি) হিসাবে কাজ করে। এটি ১৯৭২ সাল পর্যন্ত কাজ করেছে এবং বিভিন্ন কোর্স পরিচালনা করেছে যেমন, সিনিয়র কর্মকর্তাদের ম্যালেরিয়া নির্মূল কোর্স, কীটতত্ত্ব প্রযুক্তিবিদ কোর্স, বিশেষ এপিডেমিওলজি কোর্স, মাইক্রোস্কোপিস্ট কোর্স, ইনসেক্ট কালেক্টর কোর্স ইত্যাদি। ১৯৬১ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে মাঠ পর্যায় থেকে কেন্দ্রীয় স্তর পর্যন্ত এমইপি -এর সমস্ত কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। মেডিক্যাল কীটতত্ত্ব বিভাগের উদ্দেশ্য ছিল ম্যালেরিয়া সম্পর্কিত সমস্ত কীটতত্ত্ব সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা এবং এমইটিসি -এর সমস্ত প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে অংশ নেওয়া। আরেকটি বিষয় ছিল ম্যালেরিয়া ভেক্টরগুলোর উপর পরীক্ষা চালিয়ে দেখা যে তারা কোন কীটনাশকের প্রতি কতটা সংবেদনশীল বা কতটা প্রতিরোধক্ষম, যদি আদৌ থেকে থাকে।
যেহেতু দেশের এমইপি ভালোভাবে চলছিল এবং ম্যালেরিয়ার সমস্যাও কমে আসছিল, তাই এমআইবি কেবল ম্যালেরিয়া নিয়ে না ভেবে অন্যান্য সংক্রামক রোগের বিষয়েও গুরুত্ব দেয়ার কথা ভেবেছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও একই রকম চিন্তা করছিল এবং এমআইবিকে সাহায্য করার জন্য বিশেষজ্ঞ ও কারিগরি সহায়তা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এইভাবে, ১৯৭২-১৯৭৫ সময়কালে স্বাস্থ্য বিভাগ এম আই বি কে শক্তিশালীকরণের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেয় এবং পরে ১৯৮৪ তে এটি আরো প্রসারিত করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘ উন্নয়ন প্রকল্প এজন্য বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় সুবিধা দেয় এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ পাঠায়। এইভাবে মহামারী সংক্রান্ত পরিষেবা নেটওয়ার্ক, পরজীবী, ভাইরাল, ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ এবং তাদের ভেক্টরগুলির উপর মৌলিক এবং প্রয়োগকৃত ক্ষেত্র গবেষণার উন্নয়নের লক্ষ্যে; এমআইপি/বিকে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে রূপান্তরিত করা হয়ে ছিল ।
বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৮১ সালে, ইনস্টিটিউটটিকে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিন (নিপসম) এর সাথে একীভূত করা হয় এবং আবার দুটি ইনস্টিটিউটের ভিন্ন উদ্দেশ্যের কারণে, ১৯৮৭ সালের জুলাই মাসে আলাদা করা হয়।
তারপর থেকে, আইইডিসিআর একটি পৃথক কীটতত্ত্ব বিভাগ পরিচালনা করে আসছে। কীটতত্ত্ব বিভাগ প্রশিক্ষিত কর্মী এবং প্রয়োাজনীয় পরীক্ষাগার (কয়েল টেস্টিং রুম, স্প্রে করার রুম এবং কীটনাশক মুক্ত কক্ষ ইত্যাদি), জেনারেশন রুম ও ইনসেক্টেরিয়াম (কীট উৎপাদন কক্ষ) দ্বারা সজ্জিত। জাতীয় পর্যায়ে নিবন্ধনের আগে জনস্বাস্থ্যের প্রতি বিভিন্ন কীটনাশকের কার্যকারিতা পরীক্ষা করার জন্য বিভাগটি বিশেষ দায়িত্ব পেয়েছে। সে জন্য বিভাগে নমুনা গ্রহণ ও প্রস্তুতি কক্ষ রয়েছে। এই বিভাগ বিভিন্ন কীটনাশক যেমন, মশার কয়েল, স্প্রে, পাইরিথ্রিওড এবং নন-পাইরিথ্রিওডস, অ্যাডাল্টিসাইড, টেমিফস ইত্যাদির জৈবিক কার্যকারিতা পরীক্ষা করার ক্ষমতা রাখে যা লার্ভিসাইড (মাঝবয়সী কীট নাশক) এবং অ্যাডাল্টিসাইড (পূর্ণবয়স্ক কীট নাশক) হিসাবে ব্যবহৃত হয়। দেশব্যাপী কীটনাশক নিবন্ধনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ‘জাতীয় কীটনাশক প্রযুক্তি কমিটি’তে সদস্য হিসেবে এই বিভাগের প্রতিনিধি রয়েছে।
এই বিভাগের পর্যাপ্ত প্রযুক্তিগত দক্ষতা রয়েছে এবং দেশে যেকোন ভেক্টরবাহিত রোগের প্রকোপ দেখা দিলে সফলভাবে বিভিন্ন কীটতত্ত্ব জরিপ প্রকল্প পরিচালনা করে থাকে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের সময় সংকট মোকাবেলায় আইইডিসিআর-এর কীটতত্ত্ব বিভাগ বিভিন্ন কীটনাশকের কার্যকারিতা পরীক্ষা, সংক্রমণ প্রতিরোধে জনসচেতনতা তৈরী ইত্যাদির মতো বেশ কয়েকটি কর্মসূচী গ্রহণ করেছিল।
নিয়মিত কাজ হিসাবে ল্যাবরেটরি প্রতি মাসে বিভিন্ন ধরনের কীটনাশকের ১০০ টিরও বেশি জৈবিক কার্যকারিতা পরীক্ষা চালায়। এর কারণ হলো ‘কীটনাশকের ব্যবহার এবং মশার সহ্য ক্ষমতা’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। অনেকদিন বা অনেক সময় কিংবা বারবার ব্যবহারের সাথে মশার মধ্যে ওই কীটনাশক প্রতিরোধের একটা ক্ষমতা বা সহ্য-ক্ষমতা সৃষ্টি হতে পারে। এর ফলাফল হল মশা মারার কীটনাশক এর কার্যক্ষমতার সামগ্রিক হ্রাস। সহজভাবে বললে নির্দেশিত হিসেবে ব্যবহার করা হলেও ওই পণ্যটি বাস্তবে আর কোন কাজ করে না বা আংশিকভাবে কাজ করে, এটি নির্দিষ্ট কোনো একটি পণ্য হতে পারে বা ওই দলভুক্ত সবগুলো কীটনাশকও হতে পারে । এ জন্য এই বিষয়ে গবেষণার উদ্দেশ্যে প্রোগ্রাম পরিকল্পনা এবং কীটনাশক নির্বাচনের জন্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
এছাড়াও কৌশলগত পরিকল্পনা, নীতিগত অগ্রগতি, মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন কর্মশালা এবং বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী/ দর্শনার্থীদের প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা এই বিভাগের নিয়মিত কাজ।