ডা. মাহমুদুল হাসান খান, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, মহাখালী
যক্ষ্মা বাংলাদেশের একটি ঘাতক ব্যাধি এবং অন্যতম জনস্বাস্থ্য সমস্যা। বিশ্বের যক্ষ্মা প্রবণ ২২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সাত নম্বরে এবং ৫০% লোকের যক্ষ্মায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ২.১৬%। কিছুদিন আগে শেষ হওয়া জাতীয় যক্ষ্মা জরিপ ২০১৫-২০১৬ হতে জানা যায় বছরে মোট যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা প্রতি লাখে ২৬০জন আর নতুন করে আক্রান্তের সংখ্যা প্রতি লাখে ২২১জন। যদিও তা গত বছরগুলোর অনুমাননির্ভর পরিসংখ্যানের চাইতে কম কিন্তু এখনও যক্ষ্মায় মৃত্যুহার প্রতি লাখে ৪৫জন। ‘জাতীয় যক্ষ্মা জরিপ ২০১৫-২০১৬’ হতে জানা যায় গ্রামাঞ্চলের চেয়ে শহরাঞ্চলে যক্ষা রোগের প্রকোপ বেশি, বিশেষ করে যেসব স্থানে জনসংখ্যার ঘনত্ব অধিক, ঠাসাঠাসি করে বসবাস করতে হয় এবং আবাসস্থলে আলো-বাতাস প্রবেশ করতে পারে না। বাংলাদেশ সামগ্রিকভাবে রোগী শনাক্ত এবং চিকিৎসা সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় অগ্রগতি অর্জন করলেও গ্রামের চেয়ে শহরাঞ্চলে এই হার অনেক কম। এর পেছনে কারণ হিসেবে অনুমান করা হয় যে গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্য কর্মীদের দ্বারা স্ক্রীনিং ও মনিটরিং ব্যবস্থা অনেকটা সহজেই চালু রাখা যায় কিন্তু শহরে (মেট্রোপলিটন ও বসতি এলাকা) রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা ব্যবস্থা যথেষ্ট হবার পরেও ঘরে ঘরে গিয়ে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছানোর কোন ব্যবস্থা নেই। এখানে রোগী শনাক্ত একমাত্র উপায় রোগী যখন নিজে এসে তার সমস্যা তুলে ধরেন।
বিপর্যস্ত যক্ষ্মা পরিস্থিতিতে ঔষধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা ‘বিষফোঁড়া’ হিসেবে দৃশ্যমান। ঔষধ প্রতিরোধী যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগী অশনাক্তকরণই যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রধান অন্তরায়। ২০১৭ সালের হিসেব মতে দেশে বর্তমানে শনাক্তকৃত মোট যক্ষা রোগীর সংখ্যা ২ লাখ ২৩ হাজার ৯২২জন। এরমধ্যে ঔষধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা আনুমানিক ৯৭০০জন বলা হলেও প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে। শনাক্তকরণ শেষে চিকিৎসার আওতায় আনা গেছে প্রায় এক হাজার রোগীকে, বাকি প্রায় ৯০০০ রোগী আমাদের অজ্ঞাতে সমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অজ্ঞতা ও দেশের সব জায়গায় হাতের নাগালে রোগ পরীক্ষার আধুনিক ব্যবস্থা না থাকায় অনেক রোগী জানেই না যে তারা যক্ষ্মায় আক্রান্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের নিবন্ধিত নতুন যক্ষা রোগীদের মধ্যে ঔষধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা রোগীর হার ২.৯% এবং পুরানো রোগীদের মধ্যে ২৯%। ঔষধ প্রতিরোধী যক্ষ্মার নতুন জরিপ চলছে, অচিরেই এ সম্পর্কে বিশদভাবে জানা যাবে।
এই অবস্থার দ্রুত নিরসনে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যক্ষ্মারোধী (স্টপ টিবি) কৌশল গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ সরকার ২০১৭ হতে ‘বাংলাদেশে যক্ষ্মাশূন্য শহর গড়েতোলা কার্যক্রম’ (জিরো টিবি সিটিস ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশ) নামে একটি যুগোপযোগী কৌশল গ্রহণ করেছে যা শহর এলাকায় বসবাসরত যক্ষ্মা রোগী শনাক্তকরণে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।
জিন এক্সপার্ট নামক (মলিকিউলার পরীক্ষা যা পিসিআর দ্বারা করা হয়) একটি তুলনামূলক সহজতর পরীক্ষার মাধ্যমে দ্রুত যক্ষা রোগ নির্ণয়সহ সেটি ঔষধ প্রতিরোধী ধরণের কি’না তাও নির্ণয় করা যায়। বর্তমানে ১৯৬টি স্থানে জিন এক্সপার্ট এর মাধ্যমে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে যক্ষা রোগ শনাক্ত করা হয়। সহযোগী উন্নয়নমূলক সংগঠন হিসেবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সাথে এ ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছে।
দেশের সাধারণ যক্ষা রোগের নিরাময় হার সন্তোষজনক, তবে ঔষধ সেবন অনিয়মিত হওয়ায় ঔষধ প্রতিরোধী যক্ষ্মায় মৃত্যুহার কমেনি। ঔষধ প্রতিরোধী যক্ষা হলে প্রধান দুই ঔষধ ‘রিফাম্পিসিন’ ও ‘আইসোনিয়াজিড’ জীবাণুর বিরুদ্ধে কাজ করেনা। যক্ষ্মার এই অবস্থা সহজে নিরাময় হয় না। তবে আক্রান্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে নিয়মিত ঔষধ সেবনে সাধারণ যক্ষ্মা সম্পূর্ণ আরোগ্যের হার ৯৫% এবং ঔষধ প্রতিরোধী যক্ষ্মার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আরোগ্যের হার ৭০%-৮০%।
ঔষধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা চিকিৎসার জন্য কার্যকরী শক্তিশালী ঔষধের সমন্বয়ে দীর্ঘ ২০ থেকে ২৪ মাস চিকিৎসা নিতে হয়, যার প্রারম্ভিক পর্যায়ে ইঞ্জেকশনসহ ৮ মাস এবং মুখে খাওয়ার ঔষধ দিয়ে বাকি সময়ে চিকিৎসা শেষ করা হয়। আশার কথা হলো ঔষধ প্রতিরোধী যক্ষার আধুনিকতম চিকিৎসা ব্যবস্থা বর্তমানে বাংলাদেশে চালু আছে। ২০১৭ সাল হতে ঔষধ প্রতিরক্ষার জন্য স্বল্প মেয়াদী চিকিৎসা পদ্ধতিও চালু আছে, যেখানে রোগী ৯ থেকে ১১ মাসের মধ্যেই পরিমিত, নিয়মিত, পর্যায়ক্রমিক ঔষধ খেয়ে ঔষধ প্রতিরোধী যক্ষ্মামুক্ত হতে পারে। একই সাথে অধিকতর জটিল ঔষধ প্রতিরোধী যক্ষ্মার জন্য নতুন ব্যয় সাশ্রয়ী ঔষধ (বেডাকুইলিন এবং ডেলামানিড) দিয়ে চিকিৎসা ব্যবস্থাও ২০১৬ সাল হতে জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, মহাখালীতে চালু আছে। এই নতুন উদ্যোগগুলি আমাদের পূর্ববর্তী প্রচেষ্টার তুলনায় যক্ষ্মা পরিস্থিতি সামাল দেবার একটি ভাল সুযোগ তৈরী করেছে বলে আশা করা যায়।