ডা. আশেক আহমেদ শহীদ রেজা, আইইডিসিআর; ডা. আহমদ রায়হান শরীফ, আইইডিসিআর
জনস্বাস্থ্য বিষয়ক পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন এবং বিভিন্ন প্রকল্প মূল্যায়নের জন্য প্রমাণ নির্ভর উপাত্ত সংগ্রহ, স্বাস্থ্য সমস্যার গতিপ্রকৃতি ও বিস্তার পরিমাপ করতে একটি সুপ্রতিষ্ঠিত নজরদারী পদ্ধতি থাকা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মূল কথা। সংক্রামক রোগ বিশেষ করে হুমকিস্বরূপ উদ্ভূত হওয়া রোগগুলোর জন্য শুরুতেই প্রাদুর্ভাব চিহ্নিত করা এবং সবসময় একইরকম কার্যকরী পন্থায় নজরদারী বহাল রাখা সবচেয়ে জরুরী।
রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) বাংলাদেশে রোগ নজরদারীর জন্য সরকার কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। আইইডিসিআর-এর বিভিন্ন রকম রোগ নজরদারী কার্যক্রমের মাঝে “অগ্রবিবেচ্য সংক্রামক রোগ” এর ওয়েবভিত্তিক নজরদারী অন্যতম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এর সহায়তায় আইইডিসিআর ওয়েবভিত্তিক রোগ নজরদারী ব্যবস্থা চালু করে। ২০০৯ সালের জুলাই মাসে ওয়েবভিত্তিক রোগ নজরদারীর প্রারম্ভিক পর্যায়ে সকল জেলার সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে একটি পিসিডি সফটওয়্যার তৈরী করা হয় এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম যেমন, ডেস্কটপ কম্পিউটার, প্রিন্টার, মডেম ইত্যাদি সরবরাহ করা হয়। সপ্তাহান্তে প্রতিটি উপজেলা থেকে সেখানে সরবরাহকৃত নির্দিষ্ট সংযুতি অনুসরণ করে রিপোর্ট প্রস্তুত করে জেলা সিভিল সার্জনের অফিসে পাঠানো হতো। জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের পরিসংখ্যান কর্মী ঐ রিপোর্ট থেকে উপাত্তসমূহ অনলাইন বা অফলাইনে আইইডিসিআর এ পাঠিয়ে দিতেন, যেখানে এই উপাত্ত কেন্দ্রীয় সার্ভারে সুরক্ষিত থাকে। আইইডিসিআর এর একটি দায়িত্বপ্রাপ্ত দল এই সিস্টেমের দেখাশোনা, উপাত্ত বিশ্লেøষণ এবং পরিচালক মহোদয়কে অবগত করানোর কাজটি করত।
বর্তমানে পিসিডি সফটওয়্যারের মাধ্যমে রিপোর্টিং-এর বদলে ডিস্ট্রিক্ট হেলথ ইনফরমেশন সফটওয়্যার (ডিএইচআইএস) নামে একটি ব্যবহার বান্ধব ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে, যা অনেক দেশেই ব্যবহৃত হয়। ডিএইচআইএস এর একটি গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা হল বাস্তবসময়ে উপাত্ত গোচরীভূত করা যায় বা সাথে সাথে উপাত্ত দেখা যায়। যে মুহূর্তে কোন একটি প্রতিষ্ঠান উপাত্ত প্রবেশ করায় সাথে সাথে তা টেবিল বা গ্রাফ আকারে অথবা ভৌগলিক বিন্যাসে দেখতে পারা যায়। এই পদ্ধতিতে রোগের প্রাদুর্ভাব খুব দ্রুত শনাক্ত করা যায়। তাই স্বল্প সময়ের মধ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হয়। ডিএইচআইএস সফটওয়্যার ব্যবহারের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল এটি উন্মুক্ত এবং প্রয়োজন মাফিক একে আগে থেকেই সাজিয়ে নেয়া যায়। প্রতি সপ্তাহে একটি নির্দিষ্ট তারিখে উপাত্ত প্রবেশ করাতে হয়, যার ফলে যিনি এ কাজটি করেন তাকে কোন দ্বিধায় পড়তে হয়না কবে উপাত্ত দিতে হবে তা নিয়ে। ওয়েবভিত্তিক এই পদ্ধতিতে এই উপাত্ত কেন্দ্রীয় সার্ভারে সংরক্ষণের পাশাপাশি একটি হার্ডডিস্ক ড্রাইভেও ব্যাকআপ হিসেবে সংরক্ষিত থাকে তাই এর নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।
বর্তমানে সরাসরিভাবে ৪৯৩ টি উপজেলার স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে ১৮টি রোগের তথ্য সপ্তাহে একবার সংগ্রহ করা হচ্ছে। এতে করে আগে ব্যবহৃত কাগুজে রিপোর্টগুলোকেও প্রতিস্থাপিত করা গিয়েছে। সব প্রকল্পের কার্যক্রমগুলোর চাহিদা পূরণে এটি একটি কম্পিউটার বান্ধব নজরদারী পদ্ধতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। নির্বাচিত পরিসংখ্যানবিদগণ ইন্টিগ্রেটেড ডিজিজ সার্ভিলেন্স- আইডিএস ফর্ম পূরণের মাধ্যমে হাসপাতালের বহির্বিভাগ, অন্তঃবিভাগ, ডায়রিয়া কেন্দ্র এবং যক্ষা কেন্দ্রগুলো থেকে উপাত্ত সংগ্রহ করে, সেই উপাত্ত ওয়েবভিত্তিক নজরদারী পদ্ধতির সার্ভারে প্রবেশ করান। এই পদ্ধতিতে নজরদারীর আওতাভুক্ত রোগগুলো হল তীব্র ডায়রিয়া, রক্ত আমাশা, নিউমোনিয়া, মারাত্মক নিউমোনিয়া, খুব মারাত্মক অসুখ , শ্বাসতন্ত্রের তীব্র সংক্রমণ, তীব্র মেনিনজাইটিস, এনকেফালাইটিস সিন্ড্রোম (মস্তিক প্রদাহ), ডেঙ্গু, তীব্র হেপাটাইটিস (যকৃতে প্রদাহ), কালাজ্বর, ত্বকের তড়কা, ম্যালেরিয়া, এনটেরিক ফিভার (টাইফয়েড জ্বর), সম্ভাব্য জলাতঙ্ক, পালমোনারী টিউবারকিউলোসিস (যক্ষা), এক্সট্রা পালমোনারী টিউবারকিউলোসিস এবং শিশুদের টিউবারকিউলোসিস (কফ পরীক্ষা পজিটিভ বা নেগেটিভ যাই হোক)।
আইইডিসিআর কয়েক বছর ধরে এই সফটওয়্যার ব্যবহার করে আসছে। এই পদ্ধতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জগুলো হলো, নিরবচ্ছিন্ন ও শক্তিশালী ইন্টারনেট সংযোগের সাথে মাঠ পর্যায়ে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগ। ৪৯৩ টি উপজেলা থেকে নিয়মিতভাবে শতভাগ রিপোর্ট এখনও একটি চ্যালেঞ্জ। তারপরেও পরিসংখ্যানবিদ এবং এর সাথে সংশ্লিøষ্ট অন্যান্য কর্মীবৃন্দের এই পদ্ধতি বিষয়ে পরিচিতকরণ, প্রশিক্ষণ, ব্যক্তিগত পর্যায়ে যোগাযোগ বৃদ্ধি, উদ্বুদ্ধকরণ, তাদের পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি বর্তমান সময়ে এই কাজকে অনেক সহজ ও উন্নত করেছে।
ওয়েব বেজড নজরদারীকে টেকসই ও সফল করতে নিবেদিতপ্রাণ নজরদারী দলের সাথে অধ্যবসায়ের সাথে উপাত্ত সংরক্ষণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিছু চ্যালেঞ্জ স্বত্বেও ওয়েবভিত্তিক নজরদারী পদ্ধতিটি দ্রুত ও বাস্তবসময়ে স্বাস্থ্য নজরদারীর ক্ষেত্রে উপাত্ত সংগ্রহের জন্য একটি অন্যতম উপায়।