Wellcome to National Portal
Text size A A A
Color C C C C

সর্ব-শেষ হাল-নাগাদ: ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

বাংলাদেশের নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার

ডা. নুসরাত মাহমুদ, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল, ফারিহা নেহরীন মির্জা, ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ

Author Email: nusratmahmud18@gmail.com

 

বাংলাদেশের নারীরা স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ, অর্থনৈতিক সুবিধা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ এবং আর্থিক নিয়ন্ত্রণসহ জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধকতা ও অসুবিধার সম্মুখীন হয়ে থাকে। যদিও বাংলাদেশে নারী পুরুষের আনুপাতিক হারে নারীরা পুরুষের চেয়ে ১% কম, জনসংখ্যায় এটি হিসেব করলে ২০ লক্ষেরও অধিক দাঁড়ায়। এই কম হওয়ার কারণ হয়তোবা শিশুহন্তা ও মাতৃসেবা থেকে বঞ্চিত হওয়া। শহরে, বিশেষ করে বস্তি এলাকায় বসবাসকারী নারীদের স্বাস্থ্যের অবস্থা, গ্রামীন নারীদের চেয়ে আরো খারাপ। এই প্রবন্ধে নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য ও সন্তান জন্মদানের অধিকার প্রসঙ্গে কিছু বিষয় আলোচনা করা হল।

নারীর উপর সহিংসতা

নারীর উপর সহিংসতার হার অত্যন্ত বেশি। এই সহিংসতা প্রত্যক্ষ করা যায়, বাড়িতে, পথেঘাটে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কর্মক্ষেত্রে, কৃষিক্ষেত্রে, উদ্বাস্তু কেন্দ্রে, সংঘর্ষ ও সংকটকালে। প্রধান যেসব কারণকে চিহ্নিত করা যায়, তার মধ্যে রয়েছে যৌতুক (৩২.৭২%), পারিবারিক দ্বন্দ্ব (৩২.৫৪%), যৌন নির্যাতন (১৯.১৫%), বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক (১১.২০%), পারিবারিক নির্যাতন (১.৩১%) এবং অন্যান্য (৩.০৬%)। বৈবাহিক ধর্ষণও প্রচুর দেখা যায়। নির্যাতনের সাথে মদ্যপান এবং মানসিক অসুস্থতাও পরিলক্ষিত হতে পারে।

ইউ এন এফ পি এ এর বিশ্ব-নারীজনসংখ্যার অবস্থা সম্পর্কিত প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশে ৪৭% নারী তার পুরুষসঙ্গী দ্বারা শারীরিক ভাবে নির্যাতিত হবার সাক্ষ্য দিয়েছে। যেখানে নারীর উপর নির্যাতনের হার অত্যাধিক, সেইরকম ১২টি দেশের তালিকায় এই প্রতিবেদনটি বাংলাদেশকে দ্বিতীয় স্থানে রেখেছে।

 ধর্ষণ

বাংলাদেশে ধর্ষণ একটি বহুল অথচ অপ্রতিবেদিত ঘটনা। ২০১৪ এর জানুয়ারী থেকে ২০১৭ এর ডিসেম্বর পর্যন্ত নারী ও শিশু ধর্ষণের ১৭,২৮৯টি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। মাত্র ৩৪৩০ টি ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়ায় ও ৬৪৯ জন দোষী সাব্যস্ত হয়। হতে পারে বাংলাদেশে স্থানীয় সালিশের মাধ্যমে ঘটনার সমঝোতা করে নেবার একটা প্রবণতা রয়েছে বলে এমন হচ্ছে। ধর্ষিতাকে বিয়ে করা থেকে আরম্ভ করে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেয়া পর্যন্ত শাস্তি হতে পারে। ২০১৩ সালে জাতিসংঘের একটি গবেষণা বলছে ৮২% গ্রামীন ও ৭৯% শহুরে পুরুষ ধরে নেয় ধর্ষণ করা তাদের অধিকার এবং এদের মাঝে ৬২.১% এজন্য কোন অপরাধবোধে ভোগে না আর ৯৫.১% এর কোন আইনী ব্যবস্থার মুখোমুখি হতে হয় না।

বাল্যবিবাহ

বিশ্বে বাল্যবিবাহের শীর্ষে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ৪র্থ এবং শিশু বধুর (৪,৪৫১,০০০, “গার্লস নট ব্রাইডস”-এ উল্লেখিত) সংখ্যাধিক্যের তালিকায় ২য়। এই হিসেবে বাংলাদেশের প্রতি ৫ জনের মাঝে ৩ জন মেয়ে বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে থাকে (ইউ এন এফ পি এ)। বাংলাদেশের বিবাহ আইনে ১৮ বছরে মেয়ে ও ২১ বছরে ছেলেদের বিবাহযোগ্য ধরা হয়। তথাপি ২০১৭ সালে অনুমোদিত বাল্যবিবাহ আইন বা চাইল্ড ম্যারেজ অ্যাক্ট বিলে বলা হয়েছে ‘বিশেষ ক্ষেত্রে’ মেয়েদের আরও আগে বিয়ে দেয়া যাবে যদিও ‘বিশেষ ক্ষেত্র’ টি কি তা সুনির্দিষ্ট করা হয় নি।

 জন্মনিরোধ

বাংলাদেশে ফার্টিলিটি (উর্বরতার) হার ৬.৩ (১৯৭৫) থেকে নেমে ২.৩ (২০১১)-তে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশী দম্পতিদের মাঝে জন্ম নিরোধকের ব্যবহারের উচ্চ মাত্রা এবং এসবের সহজলভ্যতার কারণে এই অর্জন সম্ভব হয়েছে।

বর্তমানে জন্মনিরোধক ব্যবহারের হার ৬২%। এর মাঝে আধুনিক জন্মনিরোধকের ব্যবহার শহরের মহিলাদের মাঝে ৫২% এবং গ্রামের মহিলাদের মাঝে ৪৬%। সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পদ্ধতি মুখে খাবার বড়ি (২৯%), তারপর রয়েছে ইনজেকশন (৭%), আর সবচেয়ে কম টিউবাল লাইগেশন বা স্থায়ী পদ্ধতি যা মাত্র ৫%। কনডম হলো পুরুষদের ব্যবহারযোগ্য একমাত্র পদ্ধতি যা মাত্র ৫% ব্যবহার করেন।

বাংলাদেশে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই গর্ভনিরোধক কেনা যায়। এছাড়াও, সামাজিক কর্মীরা সত্তরের দশক থেকে ব্যবহারকারীর দোরগোড়ায় গর্ভনিরোধক সরবরাহ করে আসছেন। গুটম্যাকার ইনস্টিটিউট এর প্রতিবেদন বলছে, "পিল ব্যবহারকারীরা তাদের পদ্ধতি বেছে নেওয়ার জন্য প্রধান কারণ হিসেবে এর সহজ ব্যবহার পদ্ধতিকেই উল্লেখ করেছেন (৩৫-৪১% এটি উদ্ধৃত করেছেন) এবং একজন মাঠ-কর্মী এটিকে তাদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিল। “অপর দিকে অন্যান্য পদ্ধতির ক্ষতিকর দিক বিষয়ে তাদের উদ্বেগ ছিল।”

গর্ভপাত

মায়ের জীবন রক্ষা ব্যতীত বাংলাদেশে গর্ভপাত বেআইনি (পেনাল কোড বাংলাদেশ সেকশন ৩১২-৩১৬)। গুটম্যাকার ইনিস্টিটিউট এর মতে ২০১৪ সালে ১৫-৪৯ বছর বয়সী প্রতি ১০০০ মহিলার মাঝে ২৯ জন গর্ভপাত করিয়েছেন। ৪,৩০,০০০ জন  এম আর এবং ১,১৯৪,০০০ জন অনিরাপদ উপায়ে ইচ্ছাকৃত গর্ভপাত ঘটিয়েছেন। প্রায় ৩,৮৪,০০০ জন মহিলা গর্ভপাতজনিত জটিলতা যেমন রক্তক্ষরণ, শক, সেপসিস ইত্যাদিতে ভুগেছেন। এবং ৯১% ক্লিনিক যাদের এই জটিলতা চিকিৎসা দেয়া সম্ভব ছিল তারা দিয়েছে।

এইসব জটিলতার চিকিৎসা লাভের ক্ষেত্রে শহরবাসী মহিলারা গ্রামীন মহিলাদের চেয়ে ১.৮ গুণ বেশী সুবিধা পেয়ে থাকেন। ২০০১ সালে জাতীয় জনসংখ্যা ও স্বাস্থ্য জরিপ দেখিয়েছে যে, প্রায় অর্ধেক সংখ্যক বিবাহিত মহিলা জীবনে এম.আর শব্দটি শোনেনি। যারা এম আর সুবিধা প্রদানের জন্য নিবন্ধনকৃত, তাদের মধ্যে ব্যক্তি মালিকানার ৫৩% এবং সরকারী মালিকানার ২০% প্রতিষ্ঠান এই সুবিধা দিয়েছে। এর পেছনে কারণ হতে পারে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কর্মী বা যথাযথ যন্ত্রপাতি অথবা দুটোরই অভাব। ২০১৮ সালের হিসেবে ব্যক্তিমালিকাধীন প্রতিষ্ঠান গুলোর মাত্র এক তৃতীয়াংশের যথাযথ প্রশিক্ষিত কর্মী ও সঠিক যন্ত্রপাতি ছিল।

যৌনবাহিত রোগ

লিঙ্গ বা সম্পদের অধিকার নির্বিশেষে বাংলাদেশের সকল শ্রেনীর মানুষই যৌন বাহিত রোগে আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যক্ষেত্রে যৌনরোগের প্রাদুর্ভাব একটি বড় চ্যালেঞ্জ এবং নারী স্বাস্থ্যের জন্য বিরাট হুমকি। বিপুল সংখ্যক অভিবাসী শ্রমিক বাংলাদেশে এসটিডি সংক্রমণে ভূমিকা রাখে। গনোরিয়া (২৯.৫%), সিফিলিস (১২.৬%), নন গোনোকোক্কাল ইউরেথ্রাইটিস (৪১.৫%), যৌনাঙ্গে হার্পিস (৮.৪%) এবং এইচআইভি (০.৭%) এসটিডি-র প্রধান সংক্রামক জীবাণু। তবে সাধারণ জনগণের মাঝে এইচআইভি এর প্রাদুর্ভাব কম।

উপসংহার

বাংলাদেশে গত দুই দশকে নারী স্বাস্থ্যক্ষেত্রে অনেক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। মাতৃ ও শিশু মৃত্যু হার ক্রমশ কমেছে, যদিও বাংলাদেশে অপুষ্টি এখনো একটি জটিল স্বাস্থ্য সমস্যা। একই সাথে, ক্রনিক রোগ, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ এবং দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের মতো অসংক্রামক রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্বাস্থ্যখাত এখনো জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, অপরাধ, দুর্নীতির খেসারত দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার সুশাসনের মাধ্যমে পরিস্থিতি উন্নত করতে,  এসব বিষয়ে উন্নয়নের লক্ষ্যে সুশাসন, জাতীয় নীতিকৌশল শক্তিশালীকরণের জন্য ধাত্রী দ্বারা জরুরী প্রসব সেবা নিরবছিন্ন করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মেয়েদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০০৮ সালের ৫৭% থেকে ২০১৭ সালে ৯৫.৪% এ উন্নীত হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ নারী স্বাস্থ্য উন্নয়নে রোল মডেল হিসেবে পরিগনিত হবে বলে আশা করা যায়।