ডা. তানজিলা নওরীন, ডিএমসি; এএনএম এহতেসাম কবির, এনএনসিএইচসি, এমএনসিএন্ডএএইচ, ডিজিএইসএস; কামাল ইবনে আমিন চৌধুরী, আইসিডিডিআর,বি; জুলিয়া হারিস, সিডিসি-ইউএসএ
মূল বার্তা
পাঁচ বছরের কম বয়সী (<৫) শিশুদের সংক্রামক রোগ থেকে মৃত্যুর প্রধানতম কারণ নিউমোনিয়া
বাংলাদেশে প্রায় ১৮ শতাংশ <৫ শিশুর মৃত্যুর কারণ নিউমোনিয়া
বাংলাদেশের নিউমোনিয়ায় <৫ শিশুর মৃত্যুর কারণ দেরি করে স্বাস্থ্য সেবা নিতে আসা
সমস্যার বিবরণ
পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর ১৮ শতাংশ এর কারণ নিউমোনিয়া। বিশ্বব্যাপী বছরে প্রায় ২০ লক্ষ শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায়। এটি বর্তমানে সংক্রামক রোগ থেকে <৫ শিশু মৃত্যুর প্রধান কারণ। বাংলাদেশ বিশ্বের নিউমোনিয়া সংক্রমণের উচ্চহারের মাঝে পঞ্চম। বছরে ৬০ লক্ষ শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়। চিকিৎসাসেবা নিতে বিলম্ব, মৃদু ও মাঝারি নিউমোনিয়াকে মারাত্মক পর্যায়ে ঠেলে দেয়, যা উচ্চ মৃত্যুহারের সাথে সম্পর্কিত। বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুর ১৫ শতাংশের কারণ মারাত্মক নিউমোনিয়া।
নিউমোনিয়ার চিকিৎসা নিতে দেরী করার পেছনে অন্তত তিনটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, শিশুর পরিচর্যাকারীরা নিউমোনিয়ার বিপদ চিহ্ন ও উপসর্গগুলো চিনতে পারেন না এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না রোগটা পরবর্তী জটিল অবস্থায় পৌঁছে যায় ততক্ষণ চিকিৎসাসেবা নিতে যান না। উপরন্তু রোগটা চিনতে না পারলেও প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসা নেয়ার আগ পর্যন্ত মায়েরা ঘরোয়া চিকিৎসা প্রয়োগ করতে থাকেন। এগুলো যখন বিফল হয় তখন অপেশাদার স্বাস্থ্যকর্মীর পরামর্শ নেন, যারা আসলে নিউমোনিয়ার যথাযথ ব্যবস্থা দিতে অপারগ। এর বাইরে সামাজিক রীতিনীতি মায়েদের সেই স্বাধীনতাটুকু দেয় না যে তারা সংসারের সিদ্ধান্ত দেয়া ব্যক্তি যেমন স্বামী বা শ্বাশুড়ি এদের অনুমতি না নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসাসেবা নিতে যাবেন।
পলিসি অপশন- দেশব্যাপী সচেতনতামূলক প্রচারণা
উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো হলো যেকোনো মায়ের জন্য নিউমোনিয়ার চিকিৎসা সেবা লাভের প্রথম দুয়ার। এই কেন্দ্রগুলো অ্যান্টিবায়োটিক দ্বারা মৃদু ও মাঝারি নিউমোনিয়ার চিকিৎসা শুরু করে দিতে পারে কিন্তু তারপরেও রোগীদের যথাযথ চিকিৎসার জন্য উচ্চপর্যায়ের হাসপাতালে পাঠানোর প্রয়োজন হতে পারে। তা সত্ত্বেও অনেক পরিচর্যাকারী শিশুর অবস্থা মারাত্মক না হওয়া পর্যন্ত ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যায়না।
বাংলাদেশ সরকার এই সমস্যাটাকে চিহ্নিত করে একাধিক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে সকল পর্যায়ে আইএমসিআই বা শিশুদের অসুস্থতায় সমন্বিত ব্যবস্থাপনা যেখানে প্রয়োজনে চিকিৎসার চাহিদা সম্পন্ন শিশুর জন্য রেফারেল সিস্টেম এর ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া ২০১৫ সালের মধ্যে শিশুদের নিউমোকক্কাল টিকা সরবরাহ করা। যদিও বাংলাদেশ সরকার মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা উন্নয়ন এর উদ্দেশ্যে বর্তমানে প্রায় ৬০ হাজার কমিউনিটি স্বাস্থ্য কর্মী নিয়োগ দিয়েছে যাদের সক্ষমতার মাঝে নবজাতকের জরুরী স্বাস্থ্য সেবার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু শিশুদের নিউমোনিয়ার লক্ষণ উপসর্গ নির্ণয় বা পরিচর্যাকারীদের এই বিষয়ে শেখাতে এরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়। ফলে জনগণের একটা বড় অংশ নিউমোনিয়ার উপসর্গ দ্রুত নির্ণয় যে শিশুর মৃত্যু ঠেকাতে পারে এ বিষয়ে জানেই না।
নিউমোনিয়া উপসর্গ দেখা দেবার পর দ্রুত স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নেয়া হলে নিউমোনিয়া থেকে শিশু মৃত্যুর হার প্রকৃত অর্থেই কমিয়ে আনা সম্ভব। যদিও গোড়ার দিকে উপসর্গ চিনতে পারা ও আশু চিকিৎসা বন্দোবস্ত করার সুফল সম্পর্কে পরিচর্যাকারী বা সেবাদানকারীদের জ্ঞানের অভাব রয়েছে। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের নিউমোনিয়া থেকে বাঁচাতে আমরা দেশব্যাপী প্রচারণার প্রস্তাব রাখছি, যেখানে সেবাদানকারীদের শুরুতেই উপসর্গ চিনতে পেরে তার চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে জ্ঞান দেয়া হবে।
সেবাদানকারী ও পরিবারের সদস্যদের জন্য যদি নিউমোনিয়ার উপসর্গ এবং স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে প্রাপ্ত সুবিধা সমূহ সম্পর্কে প্রচারণা চালানো হয় তাহলে এই সমস্যা নিরসন সম্ভব হবে। এই পলিসি অপশনটির মাঝে আছে টিভি/রেডিওতে প্রামাণ্যচিত্র, নাটিকা, টেলিচিত্র এবং শিশুদের নিউমোনিয়ার উপর স্বাস্থ্যকথন। পোস্টার, ইনফোগ্রাফিক্স এবং লিফলেট ইত্যাদিও সরকারী উপজেলা স্বাস্থ্য সেবা কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র এবং কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোয় নিয়োজিত শিশুদের স্বাস্থ্য সেবাদানকারীদের মধ্যে বিতরণ করা হবে।
উপরন্তু, শিশুদের স্বাস্থ্যসেবাদানকারীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে যাতে তারা নিউমোনিয়ার প্রাথমিক লক্ষণ উপসর্গ চিনে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থাপনার জন্য পরিচর্যাকারীদের অনুপ্রাণিত করতে পারে। এই স্বাস্থ্যসেবা কর্মীবৃন্দ শুরুতেই নিউমোনিয়ার চিকিৎসা দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবেন। এটি বাংলাদেশের বিদ্যমান অবকাঠামোর অন্তর্ভুক্ত রুটিন প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের আওতায় পড়বে। এই কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে কেবল মাত্র তাদের বিদ্যমান প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে বাড়তি আধাবেলা যোগ করতে হবে, তাও মাসে একবার।
প্রতিটি শিশুর জীবন বাঁচাতে খরচ
এই পলিসি অপশনটির মাধ্যমে বছরে ২৫৯২জন শিশুর জীবন রক্ষা পাবে। এর জন্য মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ৩১৫০০০ মার্কিন ডলার অর্থাৎ প্রতি শিশুর জীবন বাঁচাতে খরচ পড়বে ১২২ মার্কিন ডলার বা ১০৩৫৮/- টাকা।
সম্ভাব্যতা
প্রস্তাবিত নীতিটি কার্যত সম্ভব। বাংলাদেশ সরকার এর আগেও বিভিন্ন বার্তা সম্বলিত সফল স্বাস্থ্য শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়েছে। এই অপশনটি রাজনৈতিকভাবেও সম্ভবপর কারণ এটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা সাথে জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা সমাবস্থায় রাখতে সাহায্য করবে, যেখানে <৫ শিশুর মৃত্যু হার কমানোর ব্যাপারটিও রয়েছে।
সুপারিশসমূহ ও পরবর্তী পদক্ষেপ
গণমাধ্যম দ্বারা শিশুদের নিউমোনিয়ার শুরুর দিকের লক্ষণ উপসর্গ সম্পর্কে কার্যক্রম চালালে দেশব্যাপী পরিচর্যাকারীদের সচেতনতা বৃদ্ধি পেতে পারে এবং কোথায় গেলে তারা সঠিক সেবা পাবে সেটাও জানতে পারবে।
শিশুদের স্বাস্থ্যসেবাদানকারীদের বিদ্যমান ব্যবস্থার মধ্যে থেকে বাড়তি প্রশিক্ষণ গ্রহণ, শিশুপরিচর্যাকারীদের নিউমোনিয়া গোড়াতেই শনাক্ত করে তাদের পরিচর্যা ও ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করে তুলতে সাহায্য করবে। বাংলাদেশ সরকারের উচিত, শিশুপরিচর্যাকারীদের মাসিক আনুষ্ঠানিক সভায়, নিউমোনিয়া বিষয়ে আলোকপাত করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক আদেশ জারি করা।
বিদ্যমান স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে আমরা কারিগরি, মেডিকেল যন্ত্রপাতি ও জনশক্তি বাড়ানোর ব্যাপারে সুপারিশ করতে পারি। পাশাপাশি বিদ্যমান সম্পদ ও সংস্থানের যথাযথ ব্যবহার এবং কঠোর নজরদারি ও মূল্যায়ন ও নিশ্চিত করতে হবে। এই পলিসি অপশনটি নামমাত্র বিনিয়োগে নিউমোনিয়ার কারণে ২৫০০ শিশুমৃত্যু প্রতিহত করতে পারবে এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ২০৩০ সালের মধ্যে শিশুমৃত্যু কমিয়ে আনতে পারবে।