Wellcome to National Portal
Text size A A A
Color C C C C

সর্ব-শেষ হাল-নাগাদ: ২৭ মার্চ ২০২৪

বাংলাদেশে সিসা দূষণ সমাধানের উপায়

মিতালী দাশ, বুশরা হুমায়রা সাদাফ; 

পিওর আর্থ বাংলাদেশ;

 

সিসার বিষক্রিয়া বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য এবং অর্থনীতির জন্য ভয়ংকর একটি হুমকি। পিওর আর্থ এবং ইউনিসেফের গবেষণা প্রতিবেদন "টক্সিক ট্রুথ (২০২০)"—এর তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রায় ৩ কোটি ৬০ লক্ষ শিশু সিসার বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত যা দেশের মোট শিশুর ৬০ শতাংশ। সাম্প্রতিক সময়ে ল্যানসেটে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের উপর সিসা দূষণ মারাত্মক প্রভাব ফেলে, যে কারণে শিশুদের বুদ্ধিমত্তা সূচক বা আইকিউ পয়েন্ট প্রায় ২ কোটি পরিমাণ কমে গেছে এবং বছরে প্রায় ১,৪০,০০০ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ হৃদরোগে মারা যায়। এই স্বাস্থ্যগত ক্ষতির কারণে আর্থিক ক্ষতির পরিমান ২৮,৬৩৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার যা দেশের ৬ থেকে ৯ শতাংশ জিডিপি ঘাটতির সমান।

 

সিসা দূষণের উৎস খুঁজে বের করে পর্যবেক্ষণের জন্য খুচরা ও পাইকারি বাজার এবং গৃহস্থালি পর্যায়ে নিত্যব্যবহার্য পণ্য সংগ্রহ করে একটি গবেষণা

সিসা দূষণের উৎস ব্যাপক এবং বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে এটি আমরা প্রতিদিন যে পণ্যগুলি ব্যবহার করি সেখানে বিদ্যমান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থা — পিওর আর্থ, ২০২৩ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর "র‌্যাপিড মার্কেট স্ক্রিনিং বা আরএমএস" শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যা গিভওয়েল —এর অর্থায়নে পরিচালিত হয়েছে। বিশ্বের ২৫টি দেশের বাজারে বিক্রি হওয়া সাধারণ ভোক্তা পণ্যে সিসা শনাক্ত করার জন্য এই সমীক্ষাটি চালানো হয়েছে যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। পিওর আর্থ এর গবেষকরা বাংলাদেশের চারটি অন্যতম প্রধান জেলা — ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা এবং বরিশালে বাজার পরিদর্শন করেন। ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত চলা এই সমীক্ষায় গবেষকরা নমুনা সংগ্রহ করেন এবং একটি এক্সআরএফ (এক্স—রে ফ্লুরোসেন্স) মেশিন দিয়ে সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষা করেন। এই পরীক্ষায় দেখা যায় যে, ১৯৭টি সংগ্রহীত নমুনা সামগ্রীর মধ্যে ২৪% নমুনা সিসার নিরাপদ মাত্রা বা রেফারেন্স ভ্যালু ছাড়িয়ে গেছে। দৈনন্দিন জীবনে নিত্যব্যবহার্য নানা পণ্যসামগ্রী যেমন অ্যালুমিনিয়ামসহ বিভিন্ন ধাতব রান্নার ও খাবারের বাসনপত্র (৫৯%), সিরামিকের খাবারের বাসনপত্র (৪৪%), দেয়াল ও বিভিন্ন ধরনের রং (৩৪%), ভাত/স্টার্চ (১৭%), এবং খেলনায় (১৩%) সর্বাধিক পরিমাণে সিসার উপস্থিতি পাওয়া যায়। 

 

পিওর আর্থ বাংলাদেশের গবেষকরা ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত খুলনা জেলার মোট ৪৭টি বাড়িতে গৃহস্থালি পর্যায়ে সিসা দূষণ পর্যবেক্ষণ বা হোম বেসড অ্যাসেসমেন্ট (ঐইচবিএ) গবেষণাটি পরিচালনা করেন, যেখানে ধাতব এবং সিরামিকের রান্নার পাত্র, খেলনা, তাবিজ, গহনা এবং আরও অনেক নিত্য ব্যবহার্য পণ্যে উচ্চ মাত্রার সিসার উপস্থিতি পায়। টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুরে সিসা এসিড ব্যাটারি কারখানা পরিষ্কার ও পরিশোধনের সময় আইসিডিডিআর,বি মোট ১৪৭টি পরিবারের পরিবেশগত নমুনা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে। এতে হলুদের গুঁড়া এবং উঠানের মাটির নমুনায় উচ্চ মাত্রার সিসা পাওয়া যায়।

 

শিশুদের এবং এলাকাবাসীদের জন্য সিসা দূষণমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা

টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুরে সিসা দূষিত এলাকা পরিষ্কার এবং পরিশোধনের ফলে ছয় শতাধিক গ্রামবাসীর জন্য একটি সিসা দূষণ মুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। পিওর আর্থ সেই এলাকায় সিসা দূষণ নিয়ে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অপরিকল্পিত ও বেআইনিভাবে গড়ে ওঠা সিসা এসিড ব্যাটারি রিসাইক্লিং কারখানা থেকে সিসা দূষণ গ্রামবাসীদের উপর যে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে, সচেতনামূলক অনুষ্ঠানে তারা তা তুলে ধরে। বিভিন্ন পোস্টার, প্যাম্পফ্লেট এবং সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে সকলের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা হয়েছিল। মির্জাপুর এলাকাটি পরিষ্কার করার পর দেখা যায়, মির্জাপুরের হটস্পট গুলিতে সিসার মাত্রা কমে আসে ৬০—১০০ পিপিএম যেটি পূর্বে ছিল ১,০০,০০০ পিপিএম। পিওর আর্থ বাংলাদেশ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের সাথে যৌথ উদ্যোগে  খুলনা জেলার মোহাম্মদনগরে একটি পরিত্যক্ত সিসা এসিড ব্যাটারি রিসাইক্লিং কারখানা পরিষ্কার ও পরিশোধনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। ২০২৩ সালের জুনে সম্পন্ন হওয়া তিন মাস দীর্ঘ প্রকল্পে বিষাক্ত মাটি খনন ও স্ক্র্যাপিং, ব্যাটারি ডাম্পিং সাইটগুলিকে ক্যাপ করা, পরিষ্কার মাটি ছড়িয়ে দেওয়া, ঘর পরিষ্কার করা এবং রাস্তা পাকা করাসহ বিভিন্ন ভাবে এলাকাটি পরিষ্কার করা হয়।

 

রক্তের সিসার মাত্রা পরীক্ষা করা

পিওর আর্থ বাংলাদেশ, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং আইসিডিডিআর,বি’র সাথে যৌথভাবে বাংলাদেশের চারটি  জেলায় ৫০০ গর্ভবতী নারী এবং ৮৯৮ জন শিশুর রক্তের সিসার মাত্রা পরীক্ষা করে।  জেলাগুলো হল— ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গাজীপুর এবং মুন্সিগঞ্জ। মোট রক্তের নমুনার ২৫ শতাংশ বর্তমানে গ্রাফাইট ফার্নেস অ্যাটমিক অ্যাবসর্পশন স্পেকট্রোমেট্রি (জিএফএএএস) ব্যবহার করে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। আইসিডিডিআর,বি টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে পরিষ্কার করার আগে ২০১ শিশুর এবং পরিষ্কারের পরে ১৬৮ শিশুর রক্তে সিসার মাত্রা পরীক্ষা করে। প্রাথমিক পর্যায়ে পরিশোধনের পূর্বে শিশুদের রক্তে সিসার মাত্রা ৪৭ ক্রম/ফষ পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছে; এলাকা পরিষ্কার করার ফলে রক্তে সিসার মাত্রা ২০% কমে গেছে। এই গবেষণার ফলাফলগুলি সিসা দূষণের বিরুদ্ধে আরও জোরদার পদক্ষেপ নিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।  একই সাথে সরকারকে সারাদেশে শিশুদের রক্তের সিসার  মাত্রা নিরীক্ষণের জন্য একটি জাতীয়—স্তরের বিএলএল জরিপ শুরু করতে সাহায্য করেছে।

 

বাংলাদেশ সরকার এবং অংশীদারদের সাথে সক্ষমতা বৃদ্ধিতে একসাথে কাজ করা

সরকার (বিশেষত ডিজিএইচএস, ডিওই, এমওইএফসিসি) এবং  ইউনিসেফ, ইন্টারন্যাশনাল লেড অ্যাসোসিয়েশন (আইএলএ), ইউনেপ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এসডো, আইসিডিডিআর,বি এবং স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিসহ ১০টিরও বেশি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের সাথে একটি লেড—সেফ বাংলাদেশ কোয়ালিশন বা জোট গঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশে পিওর আর্থ সিসা দূষণের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ আরও জোরদার করেছে। পিওর আর্থ বাংলাদেশ অংশীদারদের সাথে কেস ম্যানেজমেন্ট, মনিটরিং এবং সার্ভেইলেন্স সিস্টেমের জাতীয় নির্দেশিকা সহ প্রকল্পগুলিতে কাজ করছে; এবং বেঞ্চমার্কিং অ্যাসেসমেন্ট টুলস (বিএটি) সম্পর্কে প্রশিক্ষণ, যা পরিবেশ অধিদপ্তরকে (ডিওই) সাহায্য করবে, ব্যাটারি কোম্পানি এবং এনজিওগুলিকে সিসার পরিবেশগতভাবে সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে এবং পেশাগত স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে।