Wellcome to National Portal
Text size A A A
Color C C C C

সর্ব-শেষ হাল-নাগাদ: ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

বাংলাদেশ অ্যানথ্রাক্সের বর্তমান পরিস্থিতি

ডা. আহমেদ নওশের আলম, ভাইরোলজি বিভাগ, রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট

 

স্থানীয়ভাবে “তড়কা” নামে পরিচিত ‘অ্যানথ্রাক্স’ হল একটি প্রাণী বাহিত রোগ, যা ভূমিজাত, স্পোর উৎপন্নকারী ‘ব্যাসিলাস এনথ্রাসিস’ নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা হয়। অ্যানথ্রাক্স-এর স্পোরগুলো তাপমাত্রা ও জীবাণু ধ্বংসকারী রাসায়নিকের বিপরীতে সুপ্ত অবস্থায় মাটির ভেতর কয়েক দশক টিকে থাকতে পারে। প্রাথমিকভাবে এই ব্যাকটেরিয়ার স্পোর দ্বারা সংক্রমিত খাবার ও পানির মাধ্যমে তৃণভোজী প্রাণী যেমন গরু, ভেড়া, ছাগল, ঘোড়া ও শূকর -এদের মাঝে এই রোগ সংক্রমণ ঘটে থাকে। মানুষের মধ্যে এ রোগের সংক্রমণ ঘটে ব্যাসিলাসের জীবাণু বা স্পোর দ্বারা সংক্রমিত পশু হতে তৈরী খাবার বা অন্য কোন উপজাত থেকে।

অ্যানথ্রাক্সের রোগতত্ত্ব

ব্যাসিলাস এনথ্রাসিসের জীবাণু বা স্পোর, কোন প্রাণীতে সংক্রমণ না ঘটিয়েও পরিবেশে বহুদিন টিকে থাকতে পারে শুধুমাত্র জীবাণু-স্পোর-জীবাণু চক্র বজায় রেখে। এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশী দেখা যায় ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় অঞ্চলে। তবে, সুইডেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন জায়গা থেকে এ রোগ সংক্রমণের খবর পাওয়া গিয়েছে। এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশে কদাচিৎ মানুষ ও প্রাণীদের মাঝে এ রোগের প্রাদুর্ভাবের খবর পাওয়া গিয়েছে। ২০০৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে এ রোগ মাঝে মাঝে মানুষ ও প্রাণীদের মধ্যে দেখা গেলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বারবার দেখা দিচ্ছে, যা বাংলাদেশে প্রাণীদের মধ্যে স্থায়ী সংক্রমণ নির্দেশ করছে।

২০০৯ সালের পর থেকে ৩৬ বার এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে যেখানে ১৬টি জেলায় প্রায় ২৪০০ মানুষকে এই রোগে আক্রান্ত বলে সন্দেহ করা হয়েছে। সিরাজগঞ্জ ও এর আশেপাশের জেলাগুলোতেই এই রোগ বেশী দেখা গিয়েছে। বাংলাদেশে সাধারণত মে থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে ‘তড়কা’-এর সংক্রমণ ঘটে থাকে।


 

রোগের উন্মেষ

ব্যাসিলাস এনথ্রাসিসের জীবাণু ত্বকের কোন একটি কাটা বা ছিলে যাওয়া অংশের মাধ্যমে মানব দেহে প্রবেশ করে। প্রবেশের পর স্পোরগুলো অঙ্কুরিত হয় এবং দেহের লসিকাতন্ত্রে স্থানান্তরিত হয়। সেখানে গিয়ে এই বর্ধনশীল জীবাণুরা ক্রমাগত মানব দেহের রক্ত খেতে থাকে। ব্যাকটেরিয়ার ক্যাপ্সুল বা আবরণ এবং এর ভেতরের টক্সিন বা বিষ, এই দুটিকেই তীব্র অসুস্থতার নিয়ামক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ব্যাকটেরিয়ার সুপ্তাবস্থাতে এরা মানুষের প্লøীহা ও রক্তসংবহনতন্ত্রের মাধ্যমে রক্তে পরিস্রাবিত হতে থাকে বলে রক্তে এদের উপস্থিতি বাড়তে থাকে। জীবনের শেষ কয়েক ঘন্টায় রক্তে ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ দ্রুতহারে বাড়তে থাকে (>১০৮/মি.লি.) ফলে রক্ত পুরোটাই বিষাক্ত হয়ে পড়ে। সবশেষে রক্তসংবহনতন্ত্রের পুরো কাঠামোটাই ধ্বসে পড়ে ব্যাকটেরিয়ার বিষক্রিয়ার কারণে। এই বিষক্রিয়ার ফলে রক্তনালীর আবরণ ভেঙ্গে যায় বলে দেহের ভেতরে (কিন্তু রক্তনালীর বাইরে) রক্তক্ষরণ হয় এবং অন্তিম সময়ে দেহের বাইরেও রক্তক্ষরণের চিহ্ন দেখা যায়।

ক্লিনিক্যাল বৈশিষ্ট্যসমূহ

মানবদেহে ব্যাকটেরিয়া প্রবেশের পথ অনুযায়ী অ্যানথ্রাক্স-এর চারটি ধরণ পাওয়া যায়। সবচেয়ে বেশী দেখা যায় ত্বকের অ্যানথ্রাক্স। যেখানে আক্রান্ত স্থান শুরুতে একটু উঁচু হয়ে ফুলে থাকে, চুলকানী থাকে যা পোকার কামড়ের মত মনে হয়। খুব দ্রুতই সেটা মাঝে কালো হয়ে গিয়ে ব্যথাহীন দানায় পরিণত হয়। দ্রুত এবং যথাযথ চিকিৎসা শুরু করা গেলে এটি একটি মৃদু রোগ হিসেবে সহজেই সেরে যায়। অন্ত্রনালী বা পেটের অ্যানথ্রাক্স খুবই বিরল। সংক্রমিত মাংস - কাঁচা বা অসম্পূর্ণভাবে রান্না করে খেলে এটা হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে বমি, পেট ব্যথা, পাতলা পায়খানা, জ্বর ক্ষুধামন্দা, গলায় দানা হওয়া এবং মাথাব্যথা থাকতে পারে। অ্যানথ্রাক্সের স্পোর শ্বাসের সাথে ঢুকে গেলে মানুষের শ্বাসনালী আক্রান্ত হতে পারে। এই ধরণটাই সবচেয়ে মারাত্মক এবং জৈব সন্ত্রাসের কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রধান উপসর্গগুলোর মাঝে রয়েছে কাশির সাথে রক্ত, শ্বাসকষ্ট, জ¦র এবং মাংসপেশীতে ব্যথা। সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ ইউরোপের হেরোইনসেবীদের মাঝে আর এক রকমের অ্যানথ্রাক্স দেখা গিয়েছে যেটিকে ‘ইঞ্জেকশন অ্যানথ্রাক্স’ বলা হচ্ছে।

সব রকমের অ্যানথ্রাক্সেই মানুষের পুরোদেহে জটিলতার ঝুঁকি থাকে (মেনিঞ্জাইটিসসহ বা ছাড়া) যাকে সিস্টেমিক অ্যানথ্রাক্স বলা হয়।

মানবদেহের অ্যানথ্রাক্স চিকিৎসা

অধিকাংশ (৯৫%) অ্যানথ্রাক্স রোগীই ত্বকের অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়ে বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। আমাদের দেশে প্রধানত সহজাত সংস্পর্শের মাধ্যমেই অ্যানথ্রাক্স জীবাণু মানবদেহে প্রবেশ করে। (যেমন অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত পশু বা এর চামড়াসহ অন্য উপজাতের সংস্পর্শে আসা)। এরকম সন্দেহজনক রোগীকে রোগ প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে দশ দিনের এন্টিবায়োটিক চিকিৎসা ব্যবস্থা দিতে হবে। জটিলতা হয়নি এমন অ্যানথ্রাক্স রোগীর চিকিৎসায় মুখে খাবার ১ টি এন্টিবায়োটিক ওষুধ দেয়া হয়। এক্ষেত্রে ফ্লুরোকুইনোলোন, (সিপ্রোফ্লক্সাসিন, লেভোফ্লক্সাসিন, অথবা মক্সিফ্লক্সাসিন) অথবা ডক্সিসাইক্লিন হলো নির্দেশিত ওষুধ। যদি ক্ষেত্রবিশেষে এই ওষুধগুলো প্রতিনির্দেশিত হয় বা না পাওয়া যায় তবে ক্লিন্ডামাইসিন ব্যবহার করা যেতে পারে। শিশু ও গর্ভবতী মহিলাদের জন্য সিপ্রোফ্লক্সাসিন প্রথম পছন্দ। তারপর রয়েছে যথাক্রমে এমোক্সিসিলিন ও ডক্সিসাইক্লিন। দশদিনের এন্টিবায়োটিক কোর্সই যথেষ্ট। মেনিনজাইটিসবিহীন সিস্টেমিক অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত রোগীর ২টি এন্টিবায়োটিক প্রয়োজন, যার একটি কাজ করবে ব্যাকটেরিয়া নিধনে অন্যটি তার আমিষ সংশ্লে­ষণ প্রতিহত করতে। এরকম ক্ষেত্রে রোগীর ওষুধ সরাসরি শিরাপথে আরম্ভ করতে হবে এবং ২ সপ্তাহ বা যতক্ষণ না রোগী স্থিতাবস্থায় ফিরছেন ততক্ষণ চালু রাখতে হবে। রোগী যদি মেনিনজাইটিসসহ অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হন তাহলে শুরুতে তিনটি এন্টিবায়োটিক দিতে হবে ২-৩ সপ্তাহের জন্য অথবা যতক্ষণ না রোগী স্থিতিশীল অবস্থায় আসছেন (যেটি দীর্ঘতর হয় সেটিই ধরতে হবে)।

অ্যানথ্রাক্স রোগীকে অধিকতর চিকিৎসার জন্য অন্যত্র প্রেরণ

সহজাত বা প্রাকৃতিক ভাবে আক্রান্ত জটিলতাহীন রোগীর চিকিৎসা উপজেলা হাসপাতালের বহির্বিভাগেই সম্ভব। ত্বকের অ্যানথ্রাক্সের সাথে যদি অন্যান্য শারীরিক সমস্যা থাকে, মাথা ও ঘাড়ে বড় ঘা থাকে, অন্ত্রনালীর বা শ্বাসনালীর অ্যানথ্রাক্স হয়ে থাকে (মেনিনজাইটিস ছাড়া বা সহ) তাহলে উন্নত চিকিৎসার জন্য জেলা সদর হাসপাতাল বা মেডিকেল কলেজ অথবা বক্ষব্যাধি হাসপাতালে পাঠাতে হবে ।


 

অ্যানথ্রাক্স নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে নজরদারী

অ্যানথ্রাক্স নিয়ন্ত্রণের জন্য রোগ নির্ণয়, নিশ্চিতকরণ, রিপোর্ট প্রদান, উপাত্ত সংগ্রহ ও সেই উপাত্তের উৎসে প্রত্যুত্তর পাঠানো ইত্যাদি কাজে একটি কার্যকরী নজরদারী ব্যবস্থা খুব জরুরী। আইইডিসিআর এই জন্য প্রয়োজনীয় বিষয় সন্নিবেশিত নজরদারী কৌশলপত্র, গবেষণাগারের প্রমিত কর্মপন্থা, প্রশ্নমালা, অনুমতিপত্র তৈরী করেছে। নজরদারীর আওতাভুক্ত স্থান থেকে গবেষণার জন্য নমুনা সংগ্রহ এবং অ্যানথ্রাক্স নজরদারীর কর্মকৌশলপত্রের সাথে পরিচিত করিয়ে প্রশিক্ষণদানের কাজ সবসময় চালু আছে। ২০১৮ এর মার্চ থেকে ৯টি নির্দিষ্ট স্থানে সক্রিয় নজরদারী শুরু হয়েছে। মেহেরপুরের গাংনী উপজেলা থেকেই প্রায় সবগুলো রোগীর খবর পাওয়া গেছে। আর কিছু সংখ্যক রোগীর খবর পাওয়া গেছে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলা থেকে। অন্য এলাকাগুলো থেকে কোন রোগীর তথ্য আসেনি।

মানবদেহের অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকরী উপায়গুলো হলো অ্যানথ্রাক্স সন্দেহ করা হচ্ছে এমন পশু জবাই, চামড়া ছাড়ানো বা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজ থেকে বিরত থাকা এবং এরকম পশুর মাংস না খাওয়া। গবাদি পশুর গণটিকাদান কার্যক্রমই সবচেয়ে ভাল উপায়। প্রথমে আক্রান্ত এলাকার সকল গরু ছাগলকে, পরে দেশের বাকী সকল গরু ছাগলকে টিকা দিতে হবে।

অ্যানথ্রাক্স সংক্রমিত মৃত প্রাণী গভীর গর্ত (কমপক্ষে ৬ ফুট) খুঁড়ে পুঁতে ফেলতে হবে, যাতে অ্যানথ্রাক্স না ছড়ায়। অনেকে এই মৃতদেহ নদী বা অন্য জলাশয়ে অথবা খোলা মাঠে ফেলে দেন, যার ফলে পরিবেশে ও মানুষের মাঝে অ্যানথ্রাক্স ছড়িয়ে পড়ে (যখন কেউ ওই সংক্রমিত মৃতদেহের সংস্পর্শে আসে)। খালি হাতে সংক্রমিত প্রাণী বা মৃতদেহ নাড়াচাড়া করাও অ্যানথ্রাক্স ছড়ানোর আরেকটি উৎস। দস্তানা বা গ্লাভস পরে বা অন্য কোন উপায়ে হাত ঢেকে নিয়ে এসব নাড়া চাড়া করলে এই রোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।

নজরদারীর আওতাভুক্ত এলাকাগুলোসহ অন্যান্য রোগাক্রান্ত এলাকায়, স্বাস্থ্যকর্মী এবং জনগণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে আইইডিসিআর স্থানীয় শিক্ষামূলক কর্মসূচীর মাধ্যমে তথ্য-শিক্ষা-যোগাযোগ উপকরণ যেমন প্রচারপত্র, পোস্টার ইত্যাদি প্রস্তুত ও বন্টন করেছে।

পরিশিষ্ট

নজরদারী থেকে প্রাপ্ত উপাত্তসমূহ বাংলাদেশে সারাবছর জুড়ে রোগাক্রান্ত এলাকাগুলোতে অ্যানথ্রাক্সের রোগতত্ত্ব বুঝতে সহায়তা করবে। পশুপালন, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, ব্যাসিলাস এনথ্রাসিস এর ভৌগলিক বিস্তৃতি সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসমূহ ভবিষ্যতে বাংলাদেশে অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কৌশল প্রণয়নে ব্যবহার করা যাবে।