একটি উত্তম-কার্যকরী নাগরিক নিবন্ধন এবং গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যান (সিআরভিএস) ব্যবস্থা, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন করে এবং মৃত্যুর কারণ সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করে। এটি ব্যক্তি এবং স্বাস্থ্যখাতের প্রয়োজনে মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য, রোগ-নির্দিষ্ট মৃত্যুহার এবং জনসংখ্যা, উর্বরতা এবং মৃত্যুহারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যান সম্পর্কিত তথ্য প্রস্তুত করে।
স্বাস্থ্যসেবা প্রদান ও ফলাফল নির্ধারণের জন্য, জন্ম এবং বিশ্বাসযোগ্য কারণ উল্লেখসহ মৃত্যু- নিবন্ধন প্রক্রিয়াকে শক্তিশালীকরণ স্বাস্থ্যখাতের একটি জটিল প্রক্রিয়া। এজন্য বিভিন্ন দেশ ও প্রকল্পে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে নতুন নতুন পন্থা প্রয়োগ করা হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেক দেশে এখনো সিআরভিএস ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয় বলে জনজীবনের বহু ঘটনা দাপ্তরিকভাবে অদৃশ্য থেকে যাচ্ছে এবং প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য ও গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যান ক্রমাগতই অনুপলব্ধ থেকে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে নতুন উদ্ভাবনকে সিআরভিএস ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণের উপাদান হিসেবে ধরা হচ্ছে এবং এটাকে সিআরভিএস ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হিসেবে চিহ্নিত করার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ের প্রস্তাবনাগুলো সিআরভিএস ব্যবস্থার উন্নয়নকল্পে স্বাস্থ্য বিষয়ক নতুন উদ্ভাবন ও প্রযুক্তির সহায়তায় ভূমিকার উপর আলোকপাত করছে। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের উদ্ভাবনগুলো জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন প্রক্রিয়াকে উন্নীত করার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে, যাতে জনগোষ্ঠীতে (কমিউনিটি) জন্ম ও মৃত্যুর হিসাব রাখা যায় এবং মৃত্যুহারের তথ্য আরো ভালো ভাবে প্রস্তুত করা হয়।
বাংলাদেশে সিআরভি সিস্টেম ব্রিটিশ শাসনামল থেকে চালু আছে। জন্ম এবং মৃত্যু নিবন্ধনের নিয়ম ১৮৭৩ সালে আইনে অন্তর্ভূক্ত হয়। একই সময়ে জনগণের একটি বিশাল অংশ বিশেষত দরিদ্র এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সম্পূর্ণরূপে অনিবন্ধিত এবং আইনী ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ‘অদৃশ্য’ থেকে যায় এবং গমনাধিকার থাকা স্বত্তেও প্রাপ্য পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হয়। নিবন্ধন করতে বাধা হিসেবে দূরত্ব ব্যয়, কষ্টসাধ্য এবং ব্যবহার প্রতিকূল প্রক্রিয়া, মান্ধাতার আমলের নিয়ম-কানুনকে ধরা হয়। ফলাফলস্বরূপ জাতীয় পর্যায়ে জন্মনিবন্ধনের বিষয়টি যা ৪৫ দিনের মধ্যে করার বিধি রয়েছে সেটি মাত্র তিন শতাংশে থমকে আছে আর মৃত্যু নিবন্ধন এক শতাংশেরও কম।
বাৎসরিক ৯ লক্ষ মৃত্যুর মাঝে ১৫% সংঘটিত হয় স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে এবং ৮৫% সংঘটিত হয় লোকালয় বা কমিউনিটিতে যেখানে চিকিৎসা সুবিধা তুলনামূলক কম। এসকল মৃত্যুর মাঝে প্রায় এক লক্ষ মৃত্যু (যার বেশীরভাগ সরকারী স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে ঘটে)
তথ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি (ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম)- এর মাধ্যমে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (ডিরেক্টর জেনারেল অব হেলথ সার্ভিসেস- ডিজিএইচএস) অধীনে বাৎসরিকভাবে নথিভূক্ত হয়। তথাপি এই মৃত্যুগুলি ‘দাপ্তরিকভাবে’ নথিভূক্ত হয় না এবং এর পেছনের কারণগুলোও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার, রোগের আন্তর্জাতিক শ্রেণীবিভাগ অনুযায়ী নথিভূক্ত হয়না। ফলস্বরূপ মৃত্যু পরিসংখ্যানে প্রায়শঃই অস্বচ্ছভাবে সংজ্ঞায়িত কারণগুলোই নিবন্ধিত হয় যা আসলে স্বাস্থ্য পরিকল্পনায় কোন কাজেই আসে না যেমন হার্টফেল, ব্রেন ডেথ বা কার্ডিওরেসপিরেটোরী অ্যারেস্ট ইত্যাদি। প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশে কোন যুক্তিসিদ্ধ ব্যবহারযোগ্য জাতীয় পর্যায়ের মৃত্যুর কারণ সংক্রান্ত উপাত্ত নেই।
একটি আধুনিক ও দ্রুত উন্নয়নশীল দেশের জন্য শাসন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জাতীয় অঙ্গীকারের অংশ হিসেবে, বাংলাদেশ সরকার সিআরভিএসকে শক্তিশালী করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এর পেছনের যুক্তি হল, পরিচয়ের আইনি প্রমাণসহ স্বতন্ত্র নাগরিকদের ক্ষমতায়ন, প্রশাসনিক দক্ষতা এবং প্রতিক্রিয়াশীলতা বৃদ্ধি, একাধিক সেক্টরে পরিষেবা প্রদানের উন্নতি, এবং উর্বরতা ও মৃত্যুর নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান প্রস্তুতের মাধ্যমে জবাবদিহিতা উন্নত করা।
বাংলাদেশে সিআরভিএস সিস্টেমের উন্নতি সাধন
জাতীয় ‘সিআরভিএস’- ব্যবস্থাকে শক্তিশালীকরণ প্রচেষ্টা, একটি পাইলট প্রকল্প 'বাংলাদেশে ঈজঠঝ সিস্টেম উন্নতির জন্য প্রযুক্তিগত সহায়তা' দিয়ে শুরু হয়েছিল যা স্বাস্থ্য, নিবন্ধন, পরিসংখ্যান, স্থানীয় সরকার বিভাগ, আইসিটি বিভাগ, বিচার, আইনি বিষয় এবং মন্ত্রিপরিষদ দপ্তরের নীতি প্রণয়নকারীদের একত্রিত করেছে। প্রধান উদ্যোগগুলির মধ্যে রয়েছে: রেজিস্ট্রার জেনারেল দপ্তরকে শক্তিশালী করার জন্য প্রযুক্তিগত সহায়তা (ওআরজি); জনগোষ্ঠী -ভিত্তিক স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে জন্ম ও মৃত্যুর ৪৫ দিনের মধ্যে তথ্য সরবরাহ ও নিবন্ধন; স্থানীয়ভাবে মৃত্যুর কারণ নির্ণয়ের জন্য মৌখিক ময়নাতদন্ত বাস্তবায়ন; হাসপাতালে মৃত্যু সনদপত্রের আন্তর্জাতিক ফর্ম এবং মৃত্যুর কারণের মেডিকেল সনদের (এমসিসিওডি) প্রবর্তন; এবং পরিসংখ্যানগত কোডিং এবং মৃত্যুর পরিসংখ্যান বিশ্লেষণের জন্য প্রশিক্ষণ এবং সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ। এই প্রকল্পের নতুনত্ব হল স্বাস্থ্যখাতের পদক্ষেপগুলোকে পুরো ‘সিআরভিএস’ শক্তিশালীকরণ ব্যবস্থার সাথে সংযুক্ত করা, যাতে নিশ্চিত করা যায় যে মৃত্যুগুলি কেবল গণনা করা হয় না বরং ‘সিআরভিএস’ ব্যবস্থার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধিত হয়। ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিস ডেটা ফর হেলথ ইনিশিয়েটিভ-এর অধীনে ভাইটাল স্ট্র্যাটেজিস, ইউএসএ, ইউনিভার্সিটি অফ মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া ডিপার্টমেন্ট ফর ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড ট্রেড (ডিএফএটি) এর প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তায় প্রকল্পটি ডিসেম্বর ২০১৬ তে চালু হয়।
পঁচিশটি হাসপাতালে এমসিসিওডি প্রবর্তন:
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সিআরভিএস বাস্তবায়িত হবার পর সেখান থেকে প্রাপ্ত মৃত্যুর পরিসংখ্যানের পেছনের কারণগুলোর পরিপূরক হিসেবে মৃত্যুর কারণের চিকিৎসা সনদপত্র চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে (বিশেষত যে প্রধান হাসপাতালগুলিতে অনেক মৃত্যু ঘটে)। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার, ইন্টারন্যাশনাল ফর্ম অফ মেডিকেল সার্টিফিকেশন অব কজ অব ডেথ ২০১৬ (এমসিসিডি) চালু করা হয়েছিল। চারটি হাসপাতালে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী কিভাবে ফর্ম পূরণ করতে হয় সে বিষয়ে চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ চালু করা হয়। একই সময়ে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো, রোগের আন্তর্জাতিক শ্রেণীবিভাগের নিয়ম অনুসারে মৃত্যুর অন্তর্নিহিত কারণের পরিসংখ্যানগত কোডিংয়ের জন্য দায়ী স্বাস্থ্য তথ্য কর্মকর্তাদের একটি ক্যাডার তৈরি করেছে। বলা উচিত যে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার স্টার্ট-আপ মর্টালিটি তালিকার (এসএমওএল) মাধ্যমে প্রাথমিক কোডিং এর কাজ বাংলাদেশে সম্পূর্ণ নতুন।
“এমসিসিওডি” এর বিষয়ে ১৫৫ জন মাস্টার ট্রেইনারসহ প্রায় ১০০০০ চিকিৎসককে মেডিকেল সার্টিফিকেশনের উপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে এমসিসিওডি- অনুসরণ করার ফলে মৃত্যুহার এবং মৃত্যুর তথ্যের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানদ-ের ব্যবহারকে প্রাতিষ্ঠানিক করা হয়েছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এখন ধীরে ধীরে সমস্ত স্বাস্থ্য সুবিধাকেন্দ্রগুলিতে এমসিসিওডি প্রয়োগ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ৫৫০০০-এরও বেশি এমসিসিওডি সম্পূর্ণ করা হয়েছে এবং বেশিরভাগ ফর্মের উপাত্ত জেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থা বা ডিএইচ আই সিস্টেমে (২য় সংস্করণ) প্রবেশ করানো হয়েছে যা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ হেলথ সার্ভিসেস-এর) তথ্য ব্যবস্থাপনা (ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন) সিস্টেম (এমআইএস) দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।
এছাড়াও, ন্যাশনাল মর্ট্যালিটি টেকনিক্যাল ওয়ার্কিং গ্রুপ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে ২০২০ সালের জুনের মধ্যে সমস্ত সরকারি হাসপাতালে এমসিসিওডি চালু করা হবে। যাইহোক, হাসপাতালে সংঘটিত মৃত্যু সরকারীভাবে নিবন্ধিত হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে কারণ বর্তমান আইনে আছে, চলতি বাসস্থান যেখানে জন্ম নিবন্ধন করা হয়েছিল সেখানেই মৃত্যু নিবন্ধন করতে হবে, মৃত্যু সংঘটনের জায়গায় নয়। যদিও মৃত ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের মৃত্যু সনদের আদর্শিক ফর্মের একটি অনুলিপি দেওয়া হয় এবং নিবন্ধন করতে উৎসাহিত করা হয়, তারপরেও খুব কম লোকই তা পূরণ করে। আরও সক্রিয়ভাবে নিবন্ধনে উৎসাহিত করার কৌশলগুলির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য এবং একটি আসন্ন আইনি পর্যালোচনা এই সমস্যাগুলির কয়েকটি স্পষ্ট করতে সাহায্য করবে। উপরন্তু, আইটি সিস্টেমের পরিকল্পিত সম্প্রসারণ ব্যবস্থা হাসপাতাল এবং রেজিস্ট্রেশন অফিসের মধ্যে তথ্য আদান- প্রদান এবং মৃত্যুর তথ্য প্রতিবেদনগুলোকে দাপ্তরিক নিবন্ধনে রূপান্তরের কাজকে আরো সহজতর করবে। এমসিসিওডি এবং এসএমওএল প্রশিক্ষণ ইতিমধ্যেই সম্পন্ন এবং চালু হয়েছে এমন হাসপাতালগুলোর তালিকা এই প্রবন্ধের সাথে ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে। (লিংক অনুসরণ করুন)
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মানদন্ড অনুযায়ী মৃত্যুর কারণ নির্ধারণের জন্য প্রধান টারশিয়ারী হাসপাতালে এমসিসিওডি সফলভাবে চালু করা হয়েছে এবং বেশিরভাগ ফর্মের ডেটা এসএমওএল এবং আইসিডি-১০ কোডিং সহ ডিএইচ আইএস-২ এ প্রবেশ করানো হয়েছে।
স্বাস্থ্য পরিষেবা অধিদপ্তরের এমআইএস এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সিআরভিএস সচিবালয় সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে এমসিসিওডি এবং এসএমওএল-এর পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে। এই বিশাল কাজের জন্য বিপুল পরিমাণ সম্পদের প্রয়োজন। আমরা আশা করি নির্ধারিত সময় সীমার মধ্যে কাজটি সম্পূর্ণ করার জন্য পর্যাপ্ত তহবিল অর্জন করা হবে।