অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন, ডা. আহমেদ নওশের আলম, ডা. এএসএম আলমগীর, আইইডিসিআর
ভেক্টর বা রোগবাহক
ভেক্টর হলো এমন একটি জীব যা নিজে রোগের কারণ নয় কিন্তু রোগ সংক্রমণকারী জীবাণু আক্রান্ত দেহ থেকে অন্য দেহে বয়ে নিয়ে যায়। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে মশা হলো ভেক্টর আর ডেঙ্গু ভাইরাস হলো রোগের জীবাণু। মানুষ হলো এই রোগের আশ্রয়দাতা বা হোস্ট।
ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত এডিস ইজিপ্টি বা এডিস এল্বোপিক্টাস জাতের স্ত্রী মশার মাধ্যমে মানুষ থেকে মানুষে এই রোগ ছড়ায় । বৃষ্টি, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, এই বিষয়গুলো মশকীর জীবনযাপন, ডিম পাড়া, ডিম ফোটা এবং রোগ ছড়ানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক বা ফ্যাক্টর।
এডিস মশা মানুষের বসতির সাথে খুব ঘনিষ্ঠভাবে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। এরা বেশিরভাগ সময়ই মানুষের বসতির আশেপাশে যেখানে তুলনামূলক পরিষ্কার পানি জমে যেমন, ফেলে রাখা বোতলের মুখ বা ভাঙা বাসন, এসবের মধ্যে ডিম পাড়ে।
এই মশারা দিবাচর, অর্থাৎ দিনের বেলা (বিশেষ করে ভোর আর সন্ধ্যা বেলায়) কামড়ায়। এরা খুব বেশি দূর উড়তে পারে না (<১১০গজ)। নিজের ডানায় ভর করে দোতলার বেশিও উঠতে পারে না, কিন্তু লিফটের সাহায্যে বা কোন কিছুর ওপর বসে এরা যে কোনো উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে।
এই মশার কামড় খুব একটা টের পাওয়া যায় না, আলতোভাবে ঘাড়ে বা পায়ের গোছে কামড়ে দেয়। এদের পেট না ভরা পর্যন্ত তাড়িয়ে দিলেও বারবার কামড়ে চলে এবং একজন থেকে অন্যজনের শরীরে বসতে থাকে। এর ফলে দ্রুত রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা বাড়ে। তাই এক মশা থেকেই ২৪ থেকে ৩৬ ঘন্টার মধ্যে পরিবারের সকলের আক্রান্ত হবার ঘটনা স্বাভাবিক।
মশা নিজে সংক্রমিত হবার ৪-১০ দিন পর থেকে সারা জীবনের জন্য রোগ সংক্রমণ করার ক্ষমতা রাখে।
এটা এখন মোটামুটি প্রমাণিত যে, এই এডিস ইজিপ্টি বা এডিস এল্বোপিক্টাস তাদের ডিমের ভেতরেও ডেঙ্গু ভাইরাসের জীবাণু বহন করতে পারে। ডিম বা ওভারির মাধ্যমে ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়ার জীবাণু বহন করার কারণে এই জীবাণু প্রকৃতিতে অনেকদিন টিকে থাকে। পাশাপাশি ভেক্টর বাহিত রোগের মহামারি আকারে বারবার দেখা দেবার পেছনে সহায়ক হিসেবে কাজ করে।
বাংলাদেশে এডিস মশা
বাংলাদেশে এডিস মশার ব্যাপ্তি বুঝতে এবং প্রতিরোধের উপায় খুঁজতে ঢাকাসহ অন্যান্য অঞ্চলে বেশ কয়েকটি জরিপ চালানো হয়েছে। সেখানে দেখা গিয়েছে, শহরাঞ্চলে প্রধানত এডিস ইজিপ্টি এবং গ্রামাঞ্চলে প্রধানত এডিস এল্বোপিক্টাসের উপস্থিতি রয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা গিয়েছে, বর্ষা এবং বর্ষা পরবর্তী মৌসুমে, বৃষ্টির সাথে সাথে এডিস মশা বৃদ্ধি পায় আর তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা এর জীবনকালের ওপর সহায়ক প্রভাব ফেলে। বাহক বা ভেক্টরের পর্যাপ্ততা এই বর্ষা পরবর্তী সময়ে ডেঙ্গু ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়িয়ে দেয়।
ঢাকায় প্রচুর পরিমাণে নির্মাণাধীন ঘরবাড়িতে জমে থাকা পানি এই মশকীর বংশবৃদ্ধির বিশাল সুযোগ তৈরি করে দেয়।
ভাইরাস
ডেঙ্গু ভাইরাস (ডিইএনভি) ফ্লাভি ভাইরাস গোত্রের সিঙ্গেল স্ট্র্যান্ডেড আরএনএ, পজিটিভ সেন্স ভাইরাস ও ফ্ল্যাভিভিরিডি পরিবারের সদস্য। কিছুদিন আগে পর্যন্ত ডেঙ্গু ভাইরাসের ৪টি সেরোটাইপ (ডিইএনভি-১, ডিইএনভি-২, ডিইএনভি-৩ ও ডিইএনভি-৪) পাওয়া যেত, যেগুলোর মাঝে ৩০%-৪০% জিনগত ভিন্নতা রয়েছে। কিন্তু খুব সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় (মালয়েশিয়া, অক্টোবর ২০১৩) পঞ্চম সেরোটাইপের অস্তিত্বের কথা জানতে পারি। এই ভাইরাসকে ৫টি ভিন্ন প্রজাতির একটি দল হিসেবে অভিহিত করা হয় যাদের মাঝে রোগতত্ত্বগত, রোগসংক্রমণতত্ত্বগত ও রোগের উপসর্গগত একটি যোগাযোগ রয়েছে। প্রাথমিকভাবে একরকমের সেরোটাইপের সংক্রমণ ওই টাইপের জীবনব্যাপী ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা তৈরি করে দেয় কিন্তু এটি অন্য সেরোটাইপের আক্রমণ ঠেকাতে পারে না, বরং পরবর্তী আক্রমণের সময় ভয়াবহভাবে ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর (ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়) বা ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোমের (রক্তক্ষরণ ও শরীরের জলশূন্যতার কারণে অচেতন হয়ে যাওয়া) দিকে ঠেলে দেয়। প্রাথমিকভাবে ডিইএনভি-১ আক্রমণের পর আবার ডিইএনভি-২ বা ডিইএনভি-৩ দ্বারা সংক্রমণ ঘটলে ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর সাধারণত দেখা দেয়। উল্লেখ্য যে আলাদা আলাদা সেরোটাইপের জন্য রোগের জটিলতাও আলাদা ধরনের হয়। এই বিষয়টা এখনো পরিষ্কার নয় যে, কেন কিছু সেরোটাইপের ভিন্নতা অন্যগুলোর চেয়ে এত বেশি মারাত্মক। যেমন সেরোটাইপ ১, ২ আর ৩ এর ক্লিনিক্যাল ম্যানিফেস্টেশন বা রোগের উপসর্গ ও জটিলতা অনেক বেশি মারাত্মক। তুলনামূলকভাবে সেরোটাইপ ৪ অনেকটাই মৃদু।