Wellcome to National Portal
Text size A A A
Color C C C C

সর্ব-শেষ হাল-নাগাদ: ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

জনস্বাস্থ্য নীতি নির্ধারণী ফোরাম: একটি অনন্য উদ্যোগ

ন্যাশনাল ডেস্ক, ন্যাশনাল বুলেটিন অব পাবলিক হেলথ

 

 

রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের একটি অনন্যসাধারণ উদ্যোগ হলো জনস্বাস্থ্য নীতি ফোরাম যা ‘চ্যাম্পস’ ডেটা টু এ্যাকশন, ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইন্টারন্যাশনাল এসোসিয়েশন অফ ন্যাশনাল পাবলিক হেলথ ইন্সটিটিউটস (ইয়ানফি)-এর কারিগরি সহায়তায় ‘ডেটা ইমপ্যাক্ট প্রোগ্রাম’ (ডিআইপি) বা ‘তথ্য-উপাত্ত থেকে নীতি প্রণয়ন’ প্রকল্পের আওতায় এগিয়ে চলেছে। এই প্রকল্প, তথ্য উপাত্ত ব্যবহার করে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত নীতির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য গবেষক ও নীতি নির্ধারকদের সক্ষমতা বৃদ্ধির সহায়ক হিসেবে প্রণীত হয়েছে। পাশাপাশি এ প্রকল্পের মাধ্যমে তথ্য উপাত্ত থেকে নীতি প্রণয়ণের উপর নীতি সংক্ষেপ তৈরিতে সক্ষমতা বিকাশ এবং সেই নীতি সংক্ষেপগুলো ফোরামে উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে নীতি নির্ধারক ও অংশীদারদের সাথে মত বিনিময়ের ফলশ্রুতিতে একটি রোগতাত্ত্বিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রোগতাত্ত্বিক তথ্য-উপাত্তকে প্রমাণ নির্ভর নীতিতে রূপান্তরের ক্ষেত্রে আইইডিসিআরের জন্য একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে।

আইইডিসিআর নবীন রোগতত্ত্ববিদ, গবেষক ও জনস্বাস্থ্যবিদদের ‘নীতি সংক্ষেপ পত্র’ তৈরিতে বিশ্লেষণী দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য একটি প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছিল। এই পরিকল্পিত প্রশিক্ষণ প্যাকেজে ছিল তথ্য-উপাত্ত, প্রামাণিক দলিল, তথ্য বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা এবং অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ (বিশেষ করে ব্যয় কার্যকারিতা)। যুক্তরাষ্ট্রের ‘সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন’ থেকে কারিগরি সহায়ক একটি প্রশিক্ষক দল এসেছিল। এই প্রকল্পে ৬টি দল জনস্বাস্থ্যের ৬টি জরুরি বিষয় নিয়ে ৬টি নীতি সংক্ষেপ পত্র প্রস্তুত করে। এই নীতি সংক্ষেপগুলো নীতি নির্ধারকদের অবগত করে তাদের মূল্যবান মতামত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে, আইইডিসিআর গত ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮ ও ১০ জানুয়ারি ২০১৯-এ দুটি ‘প্রাক নীতি সংক্ষেপ’ উপস্থাপনের আয়োজন করে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা এতে করে তাদের কাজগুলো পরিমার্জন করে পলিসি ফোরাম বা নীতি নির্ধারণী বৈঠকে চূড়ান্ত উপস্থাপনের সুযোগ পায়। এই বৈঠকটি ২০১৯-এর ৩০শে জানুয়ারি আইইডিসিআর-এ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব জনাব আসাদুল ইসলাম এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা। প্রধান অতিথি তাঁর বক্তব্যে বিশাল পরিমাণে তথ্য-উপাত্ত প্রাপ্তির পরেও তা কার্যকরী নীতিতে রূপান্তরিত না হওয়ায় পলিসি ফোরামের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি এই উদ্যোগের প্রশংসা করে একে এগিয়ে নেবার আহ্বান জানান। তিনি মূল সিদ্ধান্তগুলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নির্দিষ্ট দপ্তরের লাইন ডিরেক্টরদের জানাতে এবং তাদের সক্রিয়ভাবে এর সাথে যুক্ত থাকতে নির্দেশনা প্রদান করেন। এই বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন সংশ্লিষ্ট কর্ম পরিকল্পনার লাইন ডিরেক্টরবৃন্দ, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিগণ, গবেষক, চিকিৎসক, প্রোগ্রাম সমন্বয়ক, বেসরকারী ও ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিগণ।

উপস্থাপিত নীতি সংক্ষেপসমূহ

১। আমার সন্তান থাকুক পরোক্ষ ধূমপানমুক্ত: ধোঁয়ামুক্ত বাসগৃহের জন্য স্বত:প্রণোদিত প্রচারণা

উপাত্ত থেকে জানা যায় বাংলাদেশে ৪০% শিশু নিয়মিত পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়ে তীব্র হাঁপানি (২৩%), শ্বাসতন্ত্রের নিচের দিকে সংক্রমণ (৩৬%) এবং কানের সংক্রমণে (৩৯%) অসুস্থ হয়ে পড়ছে। ঢাকার স্কুল শিক্ষার্থীদের লালা পরীক্ষায় ৯৫ শতাংশের মাঝে কোটিনিনের উপস্থিতি শনাক্ত করা গেছে। নীতি সংক্ষেপ উপস্থাপনায় কয়েকটি পন্থার উল্লেখ থাকলেও, স্কুল শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ে শিক্ষিত করে তাদেরকেই ‘পরিবর্তনের প্রতিনিধি’ হিসেবে গড়ে তুলে পরিবারকে সচেতন করে ধূমপান ত্যাগে উদ্বুদ্ধ করার প্রস্তাবনা রাখা হয়। এই প্রস্তাবনাটির পাইলট বা অনুগবেষণা চালিয়ে এর গ্রহণযোগ্যতা পরীক্ষা করা যেতে পারে।

২। পাঁচ বছরের কম বয়সীদের নিউমোনিয়া: দ্রুত শনাক্তকরণ বাঁচাবে প্রাণ

বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১৮০০০ মৃত্যুর কারণ নিউমোনিয়া এবং এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মৃত্যু প্রতিরোধযোগ্য অর্থাৎ সময়মত রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা শুরু করলেই মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব। যত দ্রুত শিশুকে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনা হবে তত তার মৃত্যুহার প্রতিরোধ এবং এ সংক্রান্ত জটিলতা কমে আসবে। এজন্য প্রয়োজন সেবাদানকারীদের উপসর্গ ও লক্ষণ বিষয়ে সচেতনতা এবং সেবাসমূহের প্রাপ্যতা। দেশজুড়ে এ জন্য প্রচারণা চালানো প্রয়োজন যার মাঝে থাকবে- ক. গণমাধ্যমে প্রচারণা এবং খ. ৫ বছরের কমবয়সী শিশুর নিউমোনিয়ার লক্ষণ ও উপসর্গ চিনতে ও চিকিৎসা দিতে এবং কখন সেবা নিতে হবে সে বিষয়ে স্বাস্থ্যসেবা- দানকারীদের আরও সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ প্রদান।

৩। স্বাস্থ্যসেবাদানকারীদের যক্ষ্মার হাত থেকে রক্ষায় করণীয়

বিশ্বে মৃত্যুর কারণ হিসেবে যক্ষ্মার স্থান সপ্তম। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, যক্ষ্মা কেন্দ্রে কর্মরত প্রতিটি স্বাস্থ্যসেবা কর্মী এই রোগের ঝুঁকিতে আছেন। বাংলাদেশে ১২০০-এরও বেশি স্বাস্থ্যসেবাকর্মী ১৩টি বক্ষব্যাধি হাসপাতালে কর্মরত এবং তাদের ৫৪% এর মাঝে যক্ষ্মা সুপ্তাবস্থায় আছে। এই সুপ্তযক্ষ্মা সহজেই নির্ণয় করা যায়, যার চিকিৎসা খরচও কম। কিন্তু বক্ষব্যাধি হাসপাতালগুলোতে বর্তমানে কোন নিয়মিত স্ক্রিনিং বা রিপোর্টিং (রোগ নির্ণয় ও তথ্য প্রেরণ)-এর ব্যবস্থা নেই। এই প্রেক্ষিতে যক্ষ্মা কেন্দ্র ও বক্ষব্যাধি হাসপাতালগুলোতে এই স্ক্রিনিং সুবিধা ও সুপ্তযক্ষ্মা’র চিকিৎসা সেবা চালু করা এবং প্রত্যেক কর্মীর জন্য এন-৯৫ মাস্ক এর সরবরাহ ২০% থেকে বাড়িয়ে ৬০% এ উন্নীত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

৪। প্রতিটি নিঃশ্বাসই মূল্যবান, জেনে নিন আপনার যক্ষ্মা আছে কিনা: যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে যক্ষ্মা সপ্তাহ উদযাপন

বিশ্বের প্রধান ৮টি যক্ষ্মা জর্জরিত দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। যক্ষ্মারোগীদের একটি বিশাল অংশ (৪০% সাধারণ যক্ষ্মা অর্থাৎ ঔষধে ভালো হতে পারে এমন এবং ৮০% ঔষধ প্রতিরোধী যক্ষ্মায় আক্রান্ত) এখনও অচিহ্নিত। এদের চিহ্নিতকরণ এবং দ্রুত চিকিৎসা অতীব জরুরি কারণ একজন ফুসফুসের যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগী বছরে ১০ থেকে ১৫ জনকে সংক্রমিত করতে পারে। গণসচেতনতাই পারে লক্ষণ উপসর্গ চেনা ও যক্ষ্মার পরীক্ষাসহ চিকিৎসা সেবা গ্রহণের মাধ্যমে এই ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করতে। যক্ষ্মা সপ্তাহে, জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি অন্যান্য সহযোগীদের সাথে নিয়ে যক্ষ্মা দিবসকে বাড়িয়ে গণমাধ্যমে আরও ব্যাপক পরিসরে সচেতনতা, স্ক্রিনিং সুবিধা বৃদ্ধি এবং দ্রুত রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থা করার জন্য নীতি সংক্ষেপ প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়েছে।

৫। নবজাতককে বাঁচাতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে জরুরি প্রসূতিসেবা পৌঁছে দেয়ার এখনই সময়

শিশু মৃত্যুর হারে বাংলাদেশ পৃথিবীতে ৮ম (প্রতি হাজার জীবিত জন্মে ২০টি মৃত্যু) এবং মোট শিশু মৃত্যুর দুই তৃতীয়াংশই প্রতিরোধযোগ্য ‘শ্বাসকষ্ট ও সংক্রমণের’ কারণে হয়। সরকার ইতোমধ্যেই সুবিস্তৃত অবকাঠামো তৈরি করেছে জরুরি প্রসূতি সেবা ও গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী অর্থ সরবরাহের জন্য। এক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী বৃদ্ধি করলে প্রাতিষ্ঠানিক নিরাপদ প্রসবের হার বৃদ্ধি পাবে ও মৃত্যুহার কমবে। তাই নীতি প্রস্তাবনায় বর্তমানে জরুরি প্রসূতি সেবাদানকারীদের সক্ষমতা বিকাশে জরুরি প্রসূতি সেবা ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি নবজাতকের যত্ন নেওয়াার বিষয়টি শিক্ষাসূচিতে অন্তর্ভূক্ত করার উপর জোর দেয়া হয়েছে।

৬। বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে শিশুদের ক্ষমতায়ন

বাল্যবিবাহ এবং এর ফলশ্রুতিতে নারী ও পরবর্তীতে তার সন্তানদের স্বাস্থ্যগত ও সামাজিক নেতিবাচক প্রভাবের মানদন্ডে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দেশ। এই প্রেক্ষাপটের কারণ হিসেবে নারীশিশুকে সম্পদ না ভেবে বোঝা মনে করা, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব ও সামাজিক চাপ উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশে মেয়ে শিশুদের স্কুলে যাবার হার অনেক বেশি এবং বিভিন্ন দায়িত্বমূলক নেতৃত্ব প্রদানকারী কর্মকা-ে নারীর অংশগ্রহণকে উৎসাহ দেয়া হয়।

তাই নীতি প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে- নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের গৃহীত ‘কিশোর-কিশোরী সংঘ’ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রাথমিক ও উচ্চশিক্ষা দপ্তরের সমন্বয়ে ‘শিশুরাই পরিবর্তনের প্রতিনিধি’ ধারণাকে শক্তিশালী করার জন্য আরও কার্যকর বার্তা উদ্ভাবন ও সম্প্রচার করা হোক।

উপসংহার

স্থায়ী মূল সদস্য এবং সাময়িক নীতিভিত্তিক বিশেষ সদস্যদের সমন্বয়ে একটি আনুষ্ঠানিক নীতি-ফোরাম গঠন বাঞ্ছনীয়। স্বাস্থ্য সমস্যা নিরসনে নীতি প্রণয়ন ও সেগুলোর সমন্বয়ের জন্য নীতি নীর্ধারক ও বিশেষজ্ঞদের গভীর আলোচনার উদ্দেশ্যে প্রতিটি নীতি সংক্ষেপের জন্য বিষয়ভিত্তিক স্বতন্ত্র উপদল গঠনের প্রস্তাবনাও রাখা হয়েছে এই বৈঠকে। এই বৈঠকে আলোচনা ও প্রস্তাবনায় আইইডিসিআর-এর ওয়েব সাইট ও ন্যাশনাল বুলেটিন অব পাবলিক হেলথ-এর মাধ্যমে নীতি প্রস্তাবনা প্রকাশের ওপরও গুরুত্ব দেয়া হয়।