ডাক্তার জুলিয়া আহমেদ, শোহেল মোহাম্মদ, রিয়াজ মাহমুদ, বাংলাদেশ নারীপ্রগতি সংঘ
Author Email: julia.ahmed1971@gmail.com
২০১৪ সালে বাংলাদেশের জাতীয় হাইজিন (ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষা) বিষয়ক ভিত্তিমূল পর্যায়ের জরিপ কার্যের প্রকাশনা পরবর্তী পর্যবেক্ষণের জন্য ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৯ এর জানুয়ারী পর্যন্ত একটি ক্রস সেকশনাল (এককালীন) কোয়ালিটেটিভ গবেষণা চালানো হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল মাসিক স্বাস্থ্য ও ব্যক্তিগত সুরক্ষা কেন্দ্রিক বিদ্যালয়-স্বাস্থ্য নীতিমালা, কৌশল ও সহায়তা উৎস চিহ্নিত করার জন্য প্রমাণ নির্ভর সমন্বিত সংলাপ প্রণয়নে মুখ্য মন্ত্রণালয়গুলোকে সম্পৃক্ত করা।
স্থানীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাহায্যে গবেষণার জনগোষ্ঠী চিহ্নিত করা হয়। সাতটি বিভাগের ২৮ টি বিদ্যালয় ও ১১ টি মাদ্রাসাকে গবেষণার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মোট ৫৩৬ জন (৩৯৮ জন বিদ্যালয়ের, ১৩৮ জন মাদ্রাসার) কিশোরী এবং ৩৮০ জন (২৯০ জন বিদ্যালয়ের ৯৮ জন মাদ্রাসার) কিশোর গবেষণার জন্য নির্বাচিত হয়। ১৭৬ জন শিক্ষক ও ১২৯ জন শিক্ষিকা ৩৫ জন বাবা ও ১৬২ জন মা এই গবেষণার অন্তর্ভুক্ত হন। আমাদের বুলেটিনে ঐ গবেষণার কিছু প্রাসঙ্গিক ও মুখ্য ফলাফল আলোচিত হলো।
মাসিক সম্পর্কিত জ্ঞান
বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, শ্রেণী, ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে একটি সাধারণ মিল দেখা গেছে ,তা হলো “লজ্জা”। ‘মাসিক সম্পর্কে কি জানা আছে?’ জিজ্ঞাসা করলেই তারা উত্তর দিতে সংকোচ বোধ করেছে। তাদের মধ্যে থেকে সচরাচর যে উত্তর পাওয়া গেছে সেটা হলো “এটি দূষিত রক্তের একটি মাসিক ক্ষরণ। এর মাধ্যমে শরীরের বর্জ্য বের হয়ে যায়। এটি প্রাপ্তবয়স্কতার লক্ষণ, এটি সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত। এটি প্রতি মাসে দেখা দেয়। এটি মেয়েদের জন্য একটি কষ্টকর অসুস্থ অবস্থা”।
কার কাছ থেকে তারা প্রথম শুনেছে?
মাত্র ৭.২৩% মেয়ে আনুষ্ঠানিক কোন সূত্র থেকে এ সম্পর্কে জেনেছে বাকী ৯২.৭% শুনেছে মা-বোন বা নিকটাত্মীয়ের মত অনানুষ্ঠানিক সূত্র থেকে। এ বিষয়ে বিদ্যালয় ও মাদ্রাসার মেয়েদের মাঝে কোন ভিন্নতা ছিল না।
উল্টোদিকে ছেলেদের মধ্যে ৪২.৭% জেনেছে আনুষ্ঠানিক সূত্র থেকে আর ৫৭.৭৩% অনানুষ্ঠানিক (বন্ধু, আত্মীয়, প্রতিবেশী) সূত্র থেকে এবং এক্ষেত্রেও বিদ্যালয় ও মাদ্রাসার ছেলেদের মাঝে কোন তফাৎ ছিল না।
মাসিক সম্বন্ধে নানাবিধ প্রশ্নোত্তর
মাসিক সক্রান্ত নানাবিধ বিষয় নিয়ে নিয়মিত স্কুল ও মাদ্রাসার ছাত্রীদের মাঝে প্রশ্ন করা হয়। প্রাপ্ত উত্তর সমূহ পরের দুটি পৃষ্ঠায় টেবিল আকারে উপস্থাপন করা হলঃ-
স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির স্থানঃ (সকল উপাত্ত শতাংশে প্রদর্শিত)
অংশগ্রহনকারী |
ওষুধের দোকান |
ডাক্তার |
অন্যান্য* |
মাদ্রাসা ছাত্রী (১৯) |
৩৬.৮% |
০% |
৬৩.২% |
বিদ্যালয় ছাত্রী (৫২) |
৩৪.৬% |
২১.২% |
৪৪.২% |
*’এই অন্যান্য’ এর মাঝে আছে সনাতন রোগনিরাময়কারী এবং ধর্মীয় নেতা যারা মাসিকের সময় তাবিজ/ পানি পড়া ইত্যাদি দেয়।
স্বাস্থ্যসেবা না নিতে চাওয়ার কারণঃ-
অংশগ্রহনকারী |
জানেনা কোথায় যেতে হবে |
বাড়ী থেকেই যত্ন গ্রহন |
মায়েরা বলেছেন, ‘এ সমস্যা ক্ষণস্থায়ী এবং চলে যাবে |
মাদ্রাসা ছাত্রী |
২৩.৫% |
১৬.২% |
৬০.৩% |
বিদ্যালয় ছাত্রী |
১৯.২% |
৩৪.৯% |
৪৫.৯% |
মাসিকের সময় ব্যবহৃত বস্তুঃ
১। সবসময় কাপড় ব্যবহারকারীঃ ৬৭.৩৯% মাদ্রাসা ছাত্রী, ৫০.২৫% বিদ্যালয় ছাত্রী
২। সবসময় প্যাড ব্যবহারকারীঃ ৫.৮% মাদ্রাসা ছাত্রী, ২০.১% বিদ্যালয় ছাত্রী
৩। দুটোই ব্যবহারকারীঃ ২৬.৮১% মাদ্রাসা ছাত্রী, ২৯.৬৫% বিদ্যালয় ছাত্রী
‘কে এই প্যাড কিনে দেয়?’ এই প্রশ্নের উত্তরে অংশগ্রহনকারী জানালো-
অংশগ্রহনকারী |
বাবা |
মা |
বোন |
নিজে |
বিদ্যালয় ছাত্রী |
৬০.৬১% |
৫.০৫% |
১৫.১৫% |
১৯.১৯% |
মাদ্রাসা ছাত্রী |
০% |
৪৪.৪৪% |
২৪.৪৪% |
৩১.১১% |
মাসিকের সময় কাপড় ধোয়ার উৎসঃ-
অংশগ্রহনকারী |
নলকূপ |
পুকুর |
কল |
তোলা জল |
মাদ্রাসা ছাত্রী |
৬০% |
২৪.৬২% |
১৫.৩৮% |
০% |
বিদ্যালয় ছাত্রী |
১৪.৪৭% |
৫.৬৬% |
৬২.৮৯% |
১৬.৯৮% |
ব্যবহৃত কাপড় ধুতে সাবানের ব্যবহার করেঃ-
সবসময়- ৯৭.৫%, মাঝে মাঝে - ২.৪%। মাদ্রাসা ও বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের অভ্যাস একইরকম ছিল।
ব্যবহৃত ‘ধোয়া কাপড়’ শুকানোর স্থানঃ-
অংশগ্রহনকারী |
অন্য কাপড়ের নীচে |
নিজের ঘরের ভেতর |
স্নান ঘরে |
রান্নাঘরের পেছনে |
*অন্যত্র |
বিদ্যালয় ছাত্রী |
৪০.৮৮% |
২১.৩৮% |
১৫.৭২% |
১৫.৭২% |
৬.২৯% |
মাদ্রাসা ছাত্রী |
৭.৬৯% |
৭.৬০% |
১৫.৩৮% |
৪৬.১৫% |
২৩.০৮% |
*’অন্যত্র’ বলতে এখানে ঝোপঝাড়, পুকুরঘাটে, মাচার ওপর ইত্যাদি বোঝানো হয়েছে।
ব্যবহৃত প্যাড ফেলে দেবার স্থানঃ-
মাদ্রাসা ছাত্রী - ৬৪.৪% নদী-পুকুর বা খালে, ৩৫.৬% মাটিতে পুঁতে ফেলে, ০% ময়লা ফেলার নির্দিষ্ট স্থানে।
বিদ্যালয় ছাত্রী- ৫৯.৬% ময়লা ফেলার নির্দিষ্ট স্থানে।
বিদ্যালয় ও মাদ্রাসায় শৌচ ব্যবস্থাঃ-
প্রতিষ্ঠান |
সুবিধার ধরণ |
||||||||||
মাদ্রাসা (১১) |
ছাত্রীদের আলাদা শৌচাগার |
প্যাডের সহজলভ্যতা |
নিরবচ্ছিন্ন জলধারা |
সাবান |
ময়লার ঝুড়ি |
||||||
আছে |
যথেষ্ট |
আছে |
যথেষ্ট |
আছে |
যথেষ্ট |
আছে |
যথেষ্ট |
আছে |
যথেষ্ট |
|
|
৯ |
০ |
০ |
নাই |
৭ |
৫ |
০ |
নাই |
০ |
নাই |
|
|
বিদ্যালয় (২৮) |
২২ |
১৩ |
৮ |
৫ |
১৯ |
১২ |
১১ |
৩ |
৬ |
০ |
|
তথ্য সংগ্রহের সময় ৫টি বিদ্যালয়ে প্যাড এর সরবরাহ আছে বলে দেখা যায়
‘বিদ্যালয়ের শৌচ ব্যবস্থা’ নিম্নোক্ত কিছু উক্তির মাধ্যমে বোঝা যাবে-
“আমাদের বিদ্যালয়ে ছেলে ও মেয়েদের জন্য আলাদা শৌচাগার আছে কিন্তু মাসিকের সময় তা স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য যথেষ্ট নয়। আমরা যখন এগুলো ব্যবহার করি তখন অনবরত বাইরে অপেক্ষমান আরেকজন কড়া নাড়তে থাকে, অর্থাৎ আরেকজনের শৌচাগার ব্যবহার প্রয়োজন।“
“ আমরা বিদ্যালয়ে থাকাকালীন প্যাড বা কাপড় পরিবর্তন করিনা কারণ যথেষ্ট পরিষ্কার নয় এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তাও বজায় রাখার সুবিধা নেই।“
মাসিকের সময় অনুপস্থিতিঃ-
অংশগ্রহনকারী |
সবসময় |
মাঝে মাঝে |
কখনো না |
মাদ্রাসা ছাত্রী |
১৪.৪৯% |
৫৭.৯৭% |
২৭.৫৪% |
বিদ্যালয় ছাত্রী |
১২.৫৬% |
২৫.১৫% |
৬২.৩১% |
শিক্ষকদের উক্তিঃ-
সামাজিক-সাংস্কৃতিক রীতি বদলাতে দীর্ঘ সময় নেবে। এটা তখনই সম্ভব হবে যখন আমাদের সন্তানেরাই মাসিক সংক্রান্ত সামাজিক বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে।
প্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি
- মেয়েরা স্বাস্থ্যসেবা নেবার অনাগ্রহ নিয়ে বড় হচ্ছে
- মাসিক ও মাসিকের রক্ত সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞানের ঘাটতি আছে
- মাসিক সম্পর্কে জানতে ছেলেদের মাঝে আনুষ্ঠানিক (যেমন বই, ফিক্হ্, শিক্ষক, প্রচারমাধ্যম) ও মেয়েদের মাঝে অনানুষ্ঠানিক সূত্র (মা, বোন, নিকটাত্মীয়) বেশি কাজ করছে।
- নিরবচ্ছিন্ন পানি, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, অপর্যাপ্ত শৌচাগার এবং পরিচ্ছন্নতার অভাব থাকায় মেয়েরা ক্লাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্যাড পরিবর্তন করে না
- মূল ব্যক্তিদের (শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও মাতা-পিতা) সাথে শিক্ষাক্রম তৈরি ও প্রণয়নের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায় না। মেয়েরা তাদের বয়সের সন্ধিক্ষণ যথাযথ পথনির্দেশনা ছাড়াই পার করছে
- মাসিকের সময় স্বাস্থ্য সমস্যা ও এর সমাধান না খোঁজার অভ্যাস দেখা গেছে। এ গবেষণায় দেখা গেছে স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখোমুখি হওয়া সরাসরিভাবে খারাপ স্বাস্থ্যের সাথে সম্পর্কিত। ‘ল্যানসেট’ নামক গবেষণা পত্রিকায় প্রকাশিত গবেষণার সাথে এই গবেষণাটিরও মিল পাওয়া যায় যে লিঙ্গ বৈষম্যই অনেক দেশে কৈশোরের ক্ষীণ স্বাস্থ্যের মূল কারণ
- মাসিকে ব্যবহৃত কাপড় ধোয়ার পর শুকানোর প্রশ্নে এই গবেষণায় এটাই উঠে এসেছে যে মেয়েরা এ বিষয়টি জানা সত্ত্বেও মূলত সামাজিক চাপে এ বিষয়টি গোপন রাখতে রৌদ্রে এই কাপড়গুলো শুকাতে পারেনা
- ব্যবহৃত প্যাড ফেলে দেওয়ার প্রশ্নে এই গবেষণা আরেকটি গবেষণার সাথে সহমত হয় যে গ্রামাঞ্চলের মেয়েরা পুকুর বা নদীতে এগুলো ফেলে এবং ৯০ শতাংশেরও বেশি মেয়ে এগুলো অস্বাস্থ্যকর উপায়ে ফেলে যা পরিবেশবান্ধব নয়
- বেশিরভাগ বিদ্যালয়ে ছেলে - মেয়েদের আলাদা শৌচাগার থাকলেও পরিমাণে যথেষ্ট নয়। নিরবচ্ছিন্ন পানি, ব্যবহৃত প্যাড ফেলবার নির্দিষ্ট ঝুড়ি, সাবান ইত্যাদির অপর্যাপ্ততা এবং সাধারণ শৌচাগার নোংরা ও দুর্গন্ধযুক্ত থাকে। জরিপ চলাকালীন মাদ্রাসাগুলোতে আলাদা শৌচাগার পাওয়া যায়নি
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ এই গবেষণাটি ‘বাংলাদেশ নারীপ্রগতি সংঘ’-এর সহায়তায় করা হয়েছে।