অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন, ডা. আহমেদ নওশের আলম, ডা. এএসএম আলমগীর, রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট
বর্তমানে বিশ্বের ২০টি দেশে ‘ডেঙ্গভ্যক্সিয়া®’ নামক টিকাটি ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধে লাইসেন্স প্রাপ্ত।
৯-৪৫ বছর বয়সী, প্রাদুর্ভাবের ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে বসবাসকারী এবং একবার ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছেন এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ডেঙ্গু সেরোটাইপ ১, ২, ৩ ও ৪ প্রতিরোধে এই টিকা ব্যবহারের নির্দেশনা দেয়া হয়। টিকা গ্রহণের ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুস্পষ্ট নির্দেশনাটি হল “যে ব্যক্তির একবার ডেঙ্গু জ্বর হয়েছে শুধুমাত্র তাকেই এ টিকা দেয়া যাবে, আগে হয়নি এমন কেউ এই টিকা নিলে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে পারে”।
১৫টি দেশে ৪০,০০০-এর অধিক লোকের মাঝে ৬ বছর ধরে ফলোআপ ডাটা (পরবর্তী পর্যবেক্ষণ সংক্রান্ত তথ্য উপাত্ত) সহ বৃহৎ পরিসরে ক্লিনিক্যাল নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা গবেষণার পর এই টিকা বাজারজাত করা হয়।
বিশ্বে ডেঙ্গুর ৫টি ভিন্ন সেরোটাইপ থাকায় একজন ব্যক্তি একাধিকবার ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হতে পারেন। প্রথমবারের চেয়ে দ্বিতীয়বারে সংক্রমণের পরিণাম আরো মারাত্মক হতে পারে।
তাই জনশক্তি ও অর্থনৈতিক ক্ষতি ঠেকাতে প্রত্যেক ডেঙ্গু রোগীর ২য় বারের ডেঙ্গু সংক্রমণ প্রতিরোধ অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমানে আমাদের দেশে কোন ডেঙ্গু টিকা না থাকলেও ‘ডেঙ্গভ্যক্সিয়া®’ নামক টিকাটি বাংলাদেশ ঔষধ নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র পেয়েছে। তবে টিকা ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনাটি আমাদের অবশ্যই গুরুত্বের সাথে মনে রাখতে হবে।
মশা প্রতিরোধে সাম্প্রতিক অগ্রগতি
ডেঙ্গু সংক্রমণ ঠেকাতে বিজ্ঞানীরা বহুবছর ধরে মানুষকে আক্রমণকারী মশাবাহিত ভাইরাস প্রতিরোধে ‘ওলবাকিয়া ব্যাক্টেরিয়া’ নিয়ে কাজ করছেন। এই ব্যাক্টেরিয়া নিরাপদ প্রকৃতিতে অন্যান্য পোকামাকড়ের মাঝে পাওয়া গেলেও এডিস ইজিপ্টি মশায় পাওয়া যায় না।
ওলবাকিয়া মানুষের মাঝে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ লাঘবে সক্ষম হবে যদি এডিস ইজিপ্টি মশার দেহে একে ঢুকিয়ে দেয়া যায়। এটি দু’ভাবে মশার দেহে কাজ করে
১. ভাইরাসের বিরুদ্ধে মশার শরীরের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা বাড়ায়
২. ভাইরাসের বৃদ্ধি ব্যহত করে
ওলবাকিয়া ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমিত পুরুষ মশা, স্ত্রী মশাতে অপরিস্ফুটনযোগ্য (যা থেকে মশা জন্মাতে পারে না) ডিম উৎপাদন করায় বলে মশার বংশহ্রাস হয় আর স্ত্রী মশা সংক্রমিত হলে তার থেকে জন্ম নেয়া মশাগুলোও ওলবাকিয়া সংক্রমিত হয়েই জন্মায়। ফলে ধীরে ধীরে সব মশাই ওলবাকিয়া আক্রান্ত হয়ে যায়। এই অভিনব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রকৃতির স্বাভাবিক বাস্তুসংস্থানের কোন পরিবর্তন না ঘটিয়ে ডেঙ্গু ও অন্যান্য রোগ কমানো যেতে পারে। এই পুরো প্রক্রিয়াটি, প্রাকৃতিক, সাশ্রয়ী এবং টেকসই। “ওয়ার্ল্ড মাস্কিউটো প্রোগ্রাম” নামক প্রকল্প বিশ্বের ১২টি দেশে এই পদ্ধতির প্রয়োগ করে চলেছে।
বন্ধ্যা পুরুষ মশাকে কাজে লাগিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করার পদ্ধতি বা ‘স্টেরাইল ইনসেক্ট টেকনিক’ নিয়ে সাভারে পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণা সম্পূর্ণ করেছেন। এই পদ্ধতিতে গামা রশ্মি ব্যবহার করে পুরুষ মশাকে বিশেষ পদ্ধতিতে বন্ধ্যা করে প্রকৃতিতে ছেড়ে দেয়া হয় । এর ফলে বন্ধ্যা পুরুষ মশার সঙ্গে সঙ্গমের পর স্ত্রী মশা ডিম পাড়লেও তা নিষিক্ত হয় না। এভাবে বাহক মশার সংখ্যা কমায় ফলে ডেঙ্গুর ভয়াবহতাও হ্রাস পায়। এছাড়া এটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত, কার্যকর ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে এই পদ্ধতিটি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে মাঠ পর্যায়ে প্রয়োগের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।