Wellcome to National Portal
Text size A A A
Color C C C C

সর্ব-শেষ হাল-নাগাদ: ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

মারাত্মক রোগ নিপাহঃ জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ

ডা. শারমীন সুলতানা এবং অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন, ভাইরোলজি বিভাগ, আইইডিসিআর

 

 

রোগ তত্ত্ব যা বলে

নিপাহ একটি প্রাণীবাহিত উদীয়মান সংক্রামক রোগ। ১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ায় এবং ১৯৯৯ সালে সিঙ্গাপুরে মস্তিষ্কের প্রদাহের প্রাদুর্ভাব থেকে প্রথম এই অসুখটি চিহ্নিত করা হয় যেখানে মৃত্যুহার ছিল ৪০%।

২০০১ সালে বাংলাদেশে প্রথম এই রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। তখন থেকে প্রতি বছরই নিপাহ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে। প্রাথমিকভাবে বাদুড় থেকে এই ভাইরাস সংক্রমিত হয়। বাংলাদেশে খেজুর রস সংগ্রহের প্রচলিত সময়ে (ডিসেম্বর থেকে মার্চের মধ্যে) নিপা রোগের সংক্রমণ দেখা দেয়।

এখন পর্যন্ত সংক্রমিত খেজুর রস পান করাই এই রোগের প্রাথমিক ঝুঁকি বা কারণ বলে চিহ্নিত। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কারণের মধ্যে রয়েছে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে সংক্রমণ। যেমন, রোগী থেকে সেবাদানকারী অথবা স্বাস্থ্য-সেবাকর্মী যারা এই রোগে আক্রান্ত মৃতদেহ বা রোগীর ব্যবহার্য জিনিসপত্র ধরা/ ছোঁয়ার মাধ্যমে নিবিড় সান্নিধ্যে আসেন, তাদের মধ্যে সংক্রমণ হতে পারে। নির্দিষ্ট এন্টি-ভাইরাল বা ভাইরাসনাশক চিকিৎসা না থাকায় মূলত লক্ষণ দেখে চিকিৎসা করা হয়। এই জন্যে, নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। সম্প্রতি অন্যতম বিখ্যাত জার্নাল ইমার্জিং ইনফেকশন ডিজিজ-এ নিপাহ ভাইরাসের জন্য পরিচালিত পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিং প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ থেকে আইইডিসিআর, আইসিডিডিআর,বি ও ইকো হেলথ এ্যালায়েন্স, বাদুড় ও ভাইরাসের নমুনা সংগ্রহের প্রাথমিক কর্মকান্ডে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। এই জেনেটিক সিকোয়েন্স ভাইরাসটি সম্পর্কে অধিকতর জানতে সাহায্য করবে এবং নিপাহ সংক্রমণ প্রতিরোধে টিকা আবিষ্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে ।

প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ

নিপাহ রোগ প্রতিরোধ করতে হলে নিম্নোক্ত সংক্রমণ রোধ করতে হবে:

১. বাদুড় থেকে মানুষে

২. মানুষ থেকে মানুষে

  • রোগী থেকে স্বাস্থ্যসেবাকর্মীতে

  • রোগী থেকে সেবাদানকারীতে/ রোগীর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তি

  • রোগী থেকে অন্য রোগে আক্রান্ত রোগীতে

নিপাহ সংক্রমণ প্রতিরোধের কৌশলসমূহ

১. সচেতনতা কর্মসূচি

২. বিভিন্ন নজরদারি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দ্রুত রোগী শনাক্তকরণ

৩. বাড়িতে, সামাজিকভাবে এবং হাসপাতালে রোগীকে আলাদা রেখে পরিচর্যা ও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেয়া

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-এর কারিগরি সহায়তা নিয়ে ‘নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণ, নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ’-এর জন্য একটি জাতীয় নির্দেশিকা তৈরি করেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো, বেসরকারি উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান এবং সংশ্লিষ্ট আরো কিছু প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সকল স্তরের জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধিতে গণমাধ্যমে প্রচারের উদ্দেশ্যে কিছু ‘স্বাস্থ্য বার্তা’ তৈরি করে এবং টিভি স্পট, চলচ্চিত্র, রেডিও বার্তা, বিজ্ঞাপন, লিফলেট, পোস্টার ইত্যাদির মাধ্যমে নিপাহ মৌসুম ও মৌসুম পূর্ববর্তী সময় প্রতি বছর প্রচার করে থাকে।

জেলা পর্যায়ে সিভিল সার্জন এবং উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এই স্বাস্থ্য বার্তাসমূহ প্রচারের দায়িত্বে থাকেন (ছক-১)।

নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণ, নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ’-এর জন্য একটি জাতীয় নির্দেশিকায় বর্ণিত স্বাস্থ্য বার্তাগুলোতে সেবাদানকারীর সুরক্ষা (ছক-২), স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা (ছক-৩ ও ৪) এবং নিপাহ রোগীর মৃতদেহ বহনের সময় পরিবার বা ওই এলাকার মানুষের সুরক্ষায় করণীয় (ছক-৭) সম্পর্কে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

প্রাদুর্ভাবের সময় করণীয়

প্রাদুর্ভাবের সময় প্রথমেই নিপাহ রোগীকে (আশঙ্কাকৃত/সম্ভবত/নিশ্চিত) পৃথকীকরণের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে (ছক-৪)। স্বাস্থ্য সেবাদানকারীদের উচিত নিপাহ আক্রান্ত রোগীদের সেবা দেয়ার সময় ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ ব্যবহার করা (ছক-৫) এবং হাসপাতালে আশঙ্কাকৃত/সম্ভবত/নিশ্চিত নিপাহ রোগীর জন্য একবার ব্যবহারযোগ্য ও পুন:ব্যবহারযোগ্য উপকরণসমূহ যথাযথ ব্যবস্থাপনা নিয়ম মেনে ও সংক্রামক বর্জ্য বিনষ্টকরণ নীতিমালা অনুসরণ করে ধ্বংস করে ফেলা (ছক-৬)।

মৃতদেহ পরিবারে/এলাকায় নেয়ার সময়, মৃতব্যক্তির নিঃসৃত তরল মলমূত্রকে জীবিত নিপাহ আক্রান্ত রোগীর নিঃসৃত তরল ও মলমূত্রের মতই সমান সংক্রামক হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। মৃতব্যক্তিকে পরিবহণ, গোসল বা সমাহিত করার সময় পর্যাপ্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

আশঙ্কাকৃত নিপাহ রোগীর মৃতদেহ বহনের সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এসময় ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ (একবার ব্যবহারযোগ্য মাস্ক, গ্লাভস ও গাউন) পরে নিতে হবে। মৃতদেহের সংস্পর্শে আসার পর তাৎক্ষণিকভাবে সাবান পানি (বা সেনিটাইজার) দিয়ে হাত ধুতে হবে। ব্যবহৃত ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ যথাযথ বর্র্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ম মেনে ও সংক্রামক বর্জ্য বিনষ্টকরণ নীতিমালা অনুসরণ করে ধ্বংস করে ফেলতে হবে (ছক-৬)।

মৃতদেহ হাসপাতাল থেকে পরিবারে/এলাকায় নেয়ার সময় সতর্কতা অনুসরণের জন্য স্বাস্থ্যকর্মীসহ পরিবারের/এলাকার সদস্যদের সঠিক তথ্যসহ ভালভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে (ছক-৭)। মৃতদেহ পরিবহণের সময় বায়ু নিরোধক ব্যাগ ব্যবহার করতে হবে, সম্ভব না হলে কাপড় দিয়ে ঢেকে পরিবহণ করতে হবে।

 

ছক-১: কাঁচা খেজুর রস খাওয়ার মাধ্যমে নিপাহ সংক্রমণ প্রতিরোধে করণীয় বার্তা/পরামর্শসমূহ

  • কাঁচা রস খাবেন না: কিছু বাদুড় নিপাহ ভাইরাস বহন করে এবং রাতে রস খেতে গেলে নিপাহ ভাইরাস কাঁচা রসে মিশতে পারে। যে কেউ সেই কাঁচা রস খেয়ে সংক্রমিত হতে পারে

  • ফোটানো রস খাওয়া বা গুড় খাওয়া নিরাপদ

 

ছক -২: ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণ রোধে করণীয়

  • আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে আসার পর সাবান-পানি দিয়ে ভালভাবে হাত ধোয়া

  • পৃথক বিছানায় ঘুমানো

  • রোগীর কাছ থেকে কমপক্ষে দুই হাত দূরত্ব (১ মিটার বা ৩ ফুট) বজায় রাখা

  • আক্রান্ত রোগীর জিনিসপত্র আলাদা করে রাখা

  • রোগীর ব্যবহৃত জিনিসপত্র আলাদা করে সাবান ও পানি দিয়ে ধোয়া

 

ছক-৩: হাসপাতালে নিপাহ সংক্রমণ প্রতিরোধে করণীয়

  • জ্বরের সাথে অজ্ঞান/খিঁচুনি/শ্বাসকষ্টের সকল রোগীকে হাসপাতালে পৃথক ওয়ার্ড/ফ্যাসিলিটিতে ভর্তি করা

  • নিপাহ রোগীর অসুখের ইতিহাস নেয়া, শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, নমুনা সংগ্রহ বা অন্যান্য সেবাদানের সময় মাস্ক ও গ্লাভস পরা

  • সন্দেহ করা হচ্ছে এমন নিপাহ রোগীর সাথে অপ্রয়োজনীয় সান্নিধ্য/সংস্পর্শ পরিহার করা

  • হাসপাতালে সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে প্রমিত সতর্কতা অনুসরণ করা

  • এ ধরনের নিপাহ রোগী ভর্তির সাথে সাথে আইইডিসিআর এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো

সতর্কতার মানদন্ড: সঠিক নীতি অনুসরণের মাধ্যমে ব্যক্তিগত সুরক্ষা

  • হাত ধোয়া বা হ্যান্ডরাব ব্যবহার

  • ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ ব্যবহার

  • রোগী, রোগীর জিনিসপত্র ও বিছানা নিরাপদ উপায়ে নাড়াচাড়া

 

ছক -৪: পৃথক ওয়ার্ড/ফ্যাসিলিটির জন্য সতর্কতা

  • নিপাহ রোগীকে অন্য রোগীদের থেকে আলাদা করে পৃথক ওয়ার্ডে রাখা

  • সেবাদানকারীর সংখ্যা সীমিতকরা

  • নিপাহ আক্রান্ত দুই রোগীর বেডের মধ্যে কমপক্ষে ১মিটার (৩ফুট) দূরত্ব বজায় রাখা

 

ছক-৫: নিপাহ রোগীর সেবাদানে ব্যক্তি পর্যায়ের সুরক্ষায় ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ ব্যবহার

  • রোগের ইতিহাস নেয়া এবং শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময় সার্জিক্যাল মাস্ক, সার্জিক্যাল গ্লাভস ও গাউন পরে নেয়া

  • নাসারন্ধ্র ও খাদ্যনালীর নমুনা সংগ্রহ এবং নল প্রবেশ প্রক্রিয়ার সময় এন-৯৫ মাস্ক, সার্জিক্যাল গ্লাভস এবং গাউন পরে নেয়া

  • হাত জীবাণুমুক্ত রাখা (কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড সাবান পানি দিয়ে হাত ধোয়া) বা রোগীকে কোন সেবা দেওয়ার পর ১-২ মিলি এলকোহলযুক্ত জীবাণুমুক্তকারক/হ্যান্ড সেনিটাইজার (ক্লোরোহেক্সিডাইন বা ৭০% এলকোহল হ্যান্ড সেনিটাইজার) দিয়ে হাত পরিষ্কার করা

  • খাদ্য ও শ্বাসনালীর নল, অক্সিজেন মাস্ক ব্যবহারের সময় একবার ব্যবহারযোগ্য উপকরণ ব্যবহার করা বা যদি একবার ব্যবহারযোগ্য উপকরণ না পাওয়া যায়, অটোক্লেভ বা ২% গ্লুটারালডিহাইড দিয়ে জীবাণুমুক্ত করে পুনঃব্যবহার করা

 

ছক-৬: বর্জ্য ব্যবস্থাপনা/ধ্বংসকরণ

  • একবার ব্যবহারযোগ্য এবং একাধিকবার ব্যবহারযোগ্য জিনিস ও ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণসমূহ পৃথক বাক্স/বায়োহেজারড ব্যাগে রাখা

  • ধারালো বর্জ্যসমূহ পৃথক আকৃতির শক্ত পাত্রে (বাক্স, বোতল ইত্যাদি) রাখা

  • অটোক্লেভ/রাসায়নিক দ্রব্য সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট (ক্লোটেক) দিয়ে বিশুদ্ধ করা

  • ডিটারজেন্ট এবং ক্লোটেক দিয়ে কমপক্ষে দিনে একবার রোগীর কক্ষ পরিষ্কার ও সংক্রমণমুক্ত করা, বিশেষ করে বেশি ছুঁতে হয় এমন স্থান (যেমন দরজা, জানালা, টেবিল ইত্যাদি) পরিষ্কার করা

  • পুনঃব্যবহারযোগ্য উপকরণসমূহ জীবাণুমুক্ত করার জন্য

  • ০.০৫%-০.৫% ব্লিচ দ্রবনে কিংবা সাবান/ডিটারজেন্ট পানিতে ১০-৩০ মি চুবিয়ে রাখা বা অটোক্লেভ ব্যবহার করা

 

ছক-৭: মৃতদেহ থেকে জীবিত ব্যক্তিতে নিপাহ সংক্রমণ প্রতিরোধে করণীয় বার্তাসমূহ। পারিবারিক সদস্য/এলাকার সদস্যদের এই সকল সচেতনতামূলক বার্তা অনুসরণ করতে হবে

  • হাসপাতাল থেকে বাড়িতে মৃতদেহ পরিবহণের সময়, মুখমন্ডলের নিবিড় সংস্পর্শে বিশেষ করে শ্বাসনালী থেকে নির্গত তরলের সংস্পর্শে আসা থেকে বিরত থাকা

  • শোকার্ত পরিবেশে মৃতব্যক্তির মুখমন্ডল বিশেষ করে শ্বাসনালী থেকে নির্গত তরলের নিকট-সংস্পর্শে আসা থেকে বিরত থাকা

  • মৃতদেহ ধোয়া/শাস্ত্রীয় ¯œানের সময় নিজের মুখমন্ডল একখন্ড কাপড় বা গামছা দিয়ে বেঁধে নেয়া

  • সাবান দিয়ে হাত ধোয়া। মৃত ব্যক্তিকে গোসল করানো বা মৃত ব্যক্তির জিনিসপত্র ধরার পর সম্ভব হলে সাবান দিয়ে দ্রুত নিজে গোসল করে নেয়া

  • সাবান বা ডিটারজেন্ট দিয়ে পুনঃব্যবহারযোগ্য উপকরণসমূহ (জামা, কাপড়, তৈজসপত্র ইত্যাদি) ধুয়ে নেয়া

  • তোশক, লেপ, বালিশ ইত্যাদি একটানা কয়েকদিন রোদে শুকিয়ে নেয়া