ডা. শারমিন সুলতানা, ভাইরোলজি বিভাগ, আইইডিসিআর
নিপাহ ভাইরাস একটি প্রাণীবাহিত রোগ যা বাদুড় থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়। ১৯৯৯ সালে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে প্রথম এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর রোগটি শনাক্ত করা হয় । প্রায় সব রোগীর ইতিহাস থেকে দেখা যায় তারা অসুস্থ শূকরের সংস্পর্শে গিয়েছিল। নিপাহ ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত শূকরগুলোর মস্তিস্কে প্রদাহসহ শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ দেখা গিয়েছিল। শূকরগুলোর আক্রান্ত হওয়ার পেছনে কারণ ছিলো বাদুড়ের আধখাওয়া ফল ও তাদের বিষ্ঠা। মানুষ এই শূকরগুলোর দেখাশোনা করতে গিয়ে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। এসব রোগীদের প্রধানতম উপসর্গ ছিল মস্তিষ্কের প্রদাহ যেখানে মৃত্যুহার খুব বেশি (৩৯%)। তখন থেকেই ফল খেকো বাদুড়গুলোকে এই রোগের রিজার্ভেয়ার বা রোগ ছড়ানোর উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
প্রতিবেশী দেশ ভারতে ৩টি প্রাদুর্ভাবের খবর পাওয়া যায়। সেগুলো হলো শিলিগুড়িতে (২০০১), নদীয়ায় (২০০৭) এবং কেরালায় (২০১৮)। এগুলোতে মোট ৬৬ জন রোগীর মাঝে ৪৫ (৭৫%) জন মারা গিয়েছিল। এই তিনটি প্রাদুর্ভাবের প্রথম উৎস নিশ্চিত না হলেও মানুষ থেকে মানুষে ছড়ানোর ব্যাপারটি নিশ্চিত করা যায়। ফিলিপাইন্সে ২০১৪ সালের প্রাদুর্ভাবে ১৭ জন রোগীর মধ্যে ৯ জন মারা গিয়েছিল। বাংলাদেশে ২০০১ সালে প্রথম নিপাহ ভাইরাসের তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু শনাক্ত করা হয় ২০০৪ সালে। তখন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত প্রায় প্রতি বছরই নিপাহ প্রাদুর্ভাবের খবর পাওয়া যাচ্ছে। মোট ৩০৩ জন নিপাহ আক্রান্ত রোগীর মাঝে ২১১ (৭০%) জনের মৃত্যু ঘটেছে। মালয়েশিয়ার সাথে আমাদের পার্থক্য এখানেই যে আমাদের দেশে এই রোগ ছড়ায় খেজুরের রস পানের মাধ্যমে। শীতের সময় এই রস খুবই জনপ্রিয়। এ থেকেই ধারণা করা হয় বাদুড় এই রোগ সংক্রমণের উৎস।
আহরণের জন্য গাছের কান্ডের একদম ওপরের দিকে খানিকটা অংশ চেঁছে সেখানে সারারাত হাঁড়ি ঝুলিয়ে রাখা হয়। ইনফ্রারেড ক্যামেরা (যা অন্ধকারেও ছবি তুলতে পারে) দিয়ে তোলা ছবি থেকে দেখা যায় বাদুড় হাঁড়ি থেকে রস চাটছে, বা গাছের চাঁছা অংশে মুখ দিচ্ছে অথবা হাঁড়ির মধ্যে প্রস্রাব করছে। হাঁড়ির বাইরেটুকু মুছে নিয়ে তার থেকে নমুনা হিসেবে সংগ্রহ করে বিশেষ পরীক্ষা পিসিআর-এর মাধ্যমে নিপাহ ভাইরাসের আরএনএ (জিনেটিক কোড-এর প্রমাণ) নিশ্চিতভাবে শনাক্ত করা গেছে। নেশা জাতীয় পানীয় ‘তাড়ি’-ও নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। মানুষ থেকে মানুষে নিপাহ সংক্রমণের আরেকটি মাধ্যম হলো দেহরসের সংস্পর্শে আসা।
বাংলাদেশে হওয়া বেশিরভাগ প্রাদুর্ভাবগুলোই দেখা গেছে শীতের সময় হয়েছে। তাই যেসব রোগীর মস্তিষ্কে প্রদাহের লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা দেবে আর কাঁচা খেজুরের রস পানের ইতিহাস থাকবে তাদের অবশ্যই নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের সন্দেহের তালিকায় রাখতে হবে।
বেশিরভাগ নিপাহ রোগীরই (৭০-১০০%) জ্বরের ইতিহাস থাকে। অন্যান্য উপসর্গের মাঝে ঘুমঘুম ভাব, মাথাব্যাথা, এলোমেলো লাগা, ঝিমুনি, বমি, প্রায় অচেতনতার পাশাপাশি মস্তিষ্কে প্রদাহ ও শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা থাকে। প্রাথমিক সংক্রমণ ও একজন থেকে অন্যজনে ছড়ানোর মাঝে এই রোগের সুপ্তাবস্থার হেরফের হতে পারে, যার সময়সীমা ২ থেকে ৩৬ দিন।
ক্রমশ বিস্তৃতি লাভকারী নতুন জীবানুগুলোর মাঝে নিপাহ একটি, যার সংক্রমণের পথগুলো এখনো পুরোপুরি বোঝা যায়নি। উচ্চ মৃত্যুহার এবং সংক্রমণের মাধ্যমগুলো সম্পর্কে দুর্বোধ্যতার কারণে, এই ভাইরাসের ওপর গবেষণা এবং জরিপ পরিচালনার জন্য বিশেষ গুরুত্ব দেয়া জরুরি।