হাসিনা আক্তার চৌধুরী, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস
Author Email: hachowdhury01@gmail.com
প্রেক্ষাপট
গর্ভাবস্থার শুরুতেই ডায়াবেটিস নির্ণয় করে এর জটিলতা প্রতিরোধের জন্য জরুরী এবং প্রতিরোধকল্পের রূপরেখা তৈরীতে এই রোগের ইতিহাস স্পষ্ট করা প্রয়োজন। উপরন্তু, শুরুতেই এই রোগ শনাক্ত করা গেলে মা ও শিশুর স্বাস্থ্য-জটিলতা বহুলাংশে কমানো যায়। প্রচলিত ‘৭৫-গ্রাম গ্লুকোজ খেয়ে ডায়াবেটিস নির্ণয়’ গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস পরীক্ষার জন্য খুব উপযোগী নয় বলেই জ্ঞাত। বরং “১ ঘন্টা- ৫০ গ্রাম গ্লুকোজ” পদ্ধতি (৫০ গ্রাম গ্লুকোজ খেয়ে ১ ঘন্টা পর পরীক্ষা) তুলনামূলক গ্রহনযোগ্য ও সহজতর বিকল্প পন্থা হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে। [জেনে রাখা ভাল ডায়াবেটিস নির্ণয়ে চূড়ান্ত পরীক্ষা হিসেবে খালিপেটে ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজের শরবত খাইয়ে ২ ঘন্টা পর রক্তে গ্লুকোজ (শর্করা বা চিনি)-এর পরিমাণ দেখা হয়। নির্দিষ্ট মাত্রা, ৬.১১ মিলি মোল/লিটার এর বেশী থাকলে ডায়াবেটিস আছে বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু গর্ভাবস্থায় যে বিকল্প পন্থা বলা হচ্ছে তা হলো ৫০ গ্রাম গ্লুকোজের শরবত খেয়ে ১ ঘন্টা পর রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নির্ণয় যেখানে ৭.২ মিলি মোল/লিটার (৯০% ক্ষেত্রে) ৭.৮ মিলি মোল/লিটার (৮০% ক্ষেত্রে) বা তার বেশী হলে ডায়াবেটিস বলা হবে।] সচরাচর প্রয়োগকৃত ডায়াবেটিস শনাক্ত করার নির্দেশিত মাত্রা হলো- ১৩০ ও ১৪০ গ্রাম/ডিএল (৭.২-৭.৮ মিলি মোল/লিটার) এর মাঝে। অবশ্য কোন পদ্ধতিটি সবচেয়ে ভাল এই বিষয়ে কোন মতানৈক্যের তথ্য পাওয়া যায়নি। অনেক গবেষক ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীতে ১৩০ গ্রাম/ডিএল এই মাত্রাকেই সংবেদনশীলতা ও নির্দিষ্টতার দিক থেকে মূল্যায়ন করে থাকেন। যদিও এই মাত্রা বিভিন্ন জনগোষ্ঠীতে ভিন্নতর হয়ে থাকে।
পূর্ববর্তী গবেষণাগুলো থেকে দেখা যায় গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসের হার বিভিন্ন জনগোষ্ঠীতে বিভিন্ন রকম। দক্ষিন এশীয় নারীদের মাঝে এই হার সর্বোচ্চ। তাই গ্লুকোজের পরীক্ষার সহনীয় মাত্রা প্রতিটি জনগোষ্ঠীর জন্য আলাদাভাবে চিহ্নিত করা জরুরী। এই পরিপ্রেক্ষিতেই আমাদের গবেষণাটি পরিচালিত যার উদ্দেশ্য ছিল গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস নির্ণয়ে “গ্লুকোজ চ্যালেঞ্জ টেস্ট” (জিসিটি) পরীক্ষাটির নির্দেশিত মাত্রা চিহ্নিত করা এবং ডায়াবেটিস প্রতিরোধের মাধ্যমে আমাদের দেশে এর ব্যয়ভার লাঘব করা।
পদ্ধতি
ঢাকার মেরিস্টোপস ক্লিনিকে একটি ক্রসসেকশনাল প্রসপেক্টিভ (এককালীন) গবেষণা পরিচালনা করা হয় যার উদ্দেশ্য ছিল জিসিটি-এর সূচক নির্ণয় করা যেটি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিত ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট ‘ওজিটিটি’ (গ্লুকোজ সহনীয়তা দ্বারা ডায়াবেটিস নির্ণয়ে পরীক্ষা) এর সাথে সবচেয়ে বেশী সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। মোট ২২৪ জন গর্ভবতী (২৪-২৮ সপ্তাহের) এই গবেষণায় অংশগ্রহন করেন যারা মেরিস্টোপস ক্লিনিকে ‘নিয়মিত গর্ভকালীন চেকআপের’ জন্য আসতেন। গবেষণায় তাদেরকেই অন্তর্ভুক্ত করা হয় যাদের বয়স ২৫ বা তার বেশী, ২৪-২৮ সপ্তাহের গর্ভাবস্থায় আছেন এবং গর্ভকালীন ডায়াবেটিস, গ্লুকোজজনিত কোন রোগ বা এসবের সাথে সম্পৃক্ত কোন জটিলতার ইতিহাস নেই।
একটি আংশিক কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। দৈহিক পরিমাপ ও ক্লিনিক্যাল পরামিতি হিসেবের জন্য আদর্শ পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। ইতিবাচক ‘জিসিটি’ ও গর্ভাবস্থার ডায়াবেটিস নির্ণয়ের জন্য বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার স্টাডি গ্রুপ প্রণীত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ৫০ গ্রাম জিসিটি ও ওজিটিটির দুটি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। প্রতিজন অংশগ্রহনকারী খালি অথবা ভরা পেটে ৫০ গ্রাম গ্লুকোজ গ্রহন করেন এবং এর ১ ঘন্টা পর শিরাপথের রক্তরসের গ্লুকোজের মাত্রা পরিমাপ করা হয়। যেসব মহিলার রক্তে ১৩০ গ্রাম/ডিএল বা ৭.২ মিলিমোল/লিটার এর বেশী গ্লুকোজের মাত্রা পাওয়া যায় তাদের গর্ভাবস্থার ডায়াবেটিস আছে কি নেই তা নিশ্চিত হবার জন্য ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাইয়ে ২ ঘন্টা পর ওজিটিটি পরীক্ষা করা হয়। যেসব গর্ভবতীর এই পরীক্ষা চলাকালীন কোন অস্বস্তি দেখা দিয়েছিল তাদের যথাযোগ্য স্বাস্থ্য কর্মীর মাধ্যমে চিকিৎসা দেয়া হয়। আলফা মাত্রা ০.০৫ এ রেখে সকল পরীক্ষা করা হয়েছিল।
Table 1: The optimum cut-off value of post-challenge serum glucose for screening GDM by GCT
Variables |
Percentile |
Cutoff Point |
Sensitivity (%) |
Specificity (%) |
PPV (%) |
NPV (%) |
GCT |
50 th |
118.8 |
96 |
0 |
38 |
0 |
75 th |
138.6 |
87 |
34 |
46 |
80 |
|
85 th |
151.2 |
65 |
60 |
51 |
72 |
|
95 th |
174.9 |
35 |
94 |
80 |
68 |
PPV = Positive Predictive Value; NPV = Negative Predictive Value
ফলাফল
অধিকাংশ অংশগ্রহণকারীই ছিলেন গৃহবধু, শহর এলাকার বাসিন্দা এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত। বেশীরভাগের মাসিক পারিবারিক আয় ছিল ২৪০০১/- থেকে ৭৪০০০/- টাকার মধ্যে। গবেষণায় ৫৮জন (২৬%) অংশগ্রহণকারীর জিসিটি পজিটিভ এবং ১৬৬জন (৭৪%) এর নেগেটিভ ফলাফল দেখা যায়। জিসিটি পজিটিভ গ্রুপের মাঝে ৩৪জন (২১%) এবং নেগেটিভ গ্রুপের ১১জন (১৯%) এর মাসিক আয় ছিল ৬০০০/- টাকার নীচে। ২টি গ্রুপের মাঝেই অতিস্বল্পসংখ্যকের পরিবারে কারো ডায়াবেটিসের ইতিহাস ছিল।
গবেষণায় জিসিটির সংবেদনশীলতা ও নির্দিষ্টতাও পরীক্ষা করা হয় (যেখানে ফলাফল ১৩০ মিলিগ্রাম/ডিএল অতিক্রম করেছিল) এক্ষেত্রে রিসিভার অপারেটিং ক্যারেক্টারস্টিকস (আরওসি) কার্ভ (বিশেষ পরিসংখ্যান ভিত্তিক কৌশল) ব্যবহার করা হয়। এই কার্ভে যেখানে বক্ররেখাটি বাঁক খায় সেটাই সত্যিকার পজেটিভ এবং ভুল নেগেটিভ হার চিহ্নিত করার সর্বোত্তম নির্দেশিত বিন্দু হিসেবে সংখ্যাভিত্তিক হিসেব দেখা যায়। এই গবেষণায় ২৩ জন (১০.৩%) মহিলার ‘গর্ভাবস্থার ডায়াবেটিস’ পজিটিভ স্ক্রিনিং এর মাধ্যমে শনাক্ত করা হয় (টেবিল-১)। এই কার্ভটি জিসিটি এর ফলাফলকে ৯৫তম শতাংশিক হিসেবে ফেলে ‘গর্ভাবস্থার ডায়াবেটিস’ নির্ণয়ের জন্য ৩৫% সংবেদনশীল, ৯৪% নির্দিষ্টতা, ৮০% পজিটিভ প্রেডিক্টিভ ভ্যালু-পিপিভি (ইতিবাচক অনুমেয় মান) এবং ৬৮% নেগেটিভ প্রেডিক্টিভ ভ্যালু-এনপিভি (নেতিবাচক অনুমেয় মান) (ফিগার-১) এবং আরওসি বক্ররেখার ০.৭০১ পরিমাণ আওতায় আছে বলে সনাক্ত করা হয়। (ফিগার-২) এর সবই পূর্ববর্তী ফলাফলগুলোর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল।
উপসংহার
পিপিভি ও এনপিভি এর উপর ভিত্তি করে আমাদের উপাত্তগুলো ‘১ ঘন্টা- ৫০ গ্রাম’ জিসিটি পরীক্ষাকে সম্ভাবনাময় ও গ্রহণযোগ্য স্ক্রিনিং পরীক্ষা এবং ১৭৪ মিলিগ্রাম/ডিএল-কে রক্তে শর্করার নির্দেশিত পরিমাণ হিসেবে বাংলাদেশের জনগণের মাঝে ‘গর্ভাবস্থার ডায়াবেটিস’ নির্ণয়ের যথাযথ পদ্ধতি হিসেবে প্রয়োগের সুযোগ রয়েছে।