ডা. রাজিব চৌধুরী, জুলিয়া লোফ্রেডা এবং অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা, কেপেবল টিমের পক্ষে
অভীষ্ট লক্ষ্য
একটি বড় জনগোষ্ঠীর মধ্যে যদি দীর্ঘ সময় ধরে তাদের স্বাস্থ্য নিরীক্ষণ করা যায় তাহলে তাদের মাঝে উদ্ভূত রোগসমূহের নতুন সূত্র এবং প্রতিরোধের উপায় খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের সাতটি প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞরা ঠিক এই উদ্দেশ্যেই কাজ করে চলেছেন; রোগের কারণসমূহ খুঁজে বের করে নীতি নির্ধারকদের তা অবগত করে সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছেন।
শিশুমৃত্যু ও প্রজনন হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনার কারণে বাংলাদেশ আজ বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। কিন্তু আর্সেনিক দূষিত পানি পান থেকে শুরু করে লৌহের ঘাটতিসম্পন্ন খাদ্যগ্রহণ কিংবা বায়ুদূষণ থেকে শুরু করে পাশ্চাত্যের জীবনধারা অনুপ্রবেশ ইত্যাদি নানাবিধ নিয়ামকের সংমিশ্রণের ফলে দীর্ঘমেয়াদি রোগগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
ক্যামব্রিজ প্রোগ্রাম টু এসিস্ট বাংলাদেশ ইন লাইফস্টাইল এন্ড এনভায়রনমেন্টাল রিস্ক রিডাকশন, সংক্ষেপে কেপেবল এই লক্ষ্যে বাংলাদেশের সবুজ গ্রাম থেকে ঢাকা শহরের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা পর্যন্ত প্রতিটি প্রান্ত থেকে দেড় লাখেরও বেশি মানুষ নিবন্ধন করছে তাদের স্বাস্থ্য নিরীক্ষণের জন্য। সেখান থেকে প্রাপ্ত তথ্য স্বাস্থ্য গবেষক, চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী, সমাজতত্ত্ববিদ এবং অন্যান্য বিভাগের বিশেষজ্ঞরা বিশ্লেষণ করে দেখবেন কেমন করে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ নিয়ামকগুলো একটি অন্যটিকে প্রভাবিত করে, সেই সাথে তাদের কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার একটি মডেল তৈরির চেষ্টা করবেন।
অসংক্রামক রোগসমূহের চাপ
দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোর অন্যতম যেখানে নগরায়নের হারও সবচেয়ে বেশি। তাই এখানে দুটি বিষয় দিন দিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে ১. যারা শহরে বাস করেন তাদের ঝুঁকিগুলো বিশ্লেষণ এবং
২. এই জনগোষ্ঠীতে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের উন্নত উপায় অনুসন্ধান।
বাংলাদেশে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়া অসংক্রামক রোগগুলোর পেছনে পরিবেশগত ও জীবনযাত্রার প্রভাব রয়েছে। উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চাইলে বলা যায়:
১. পানি ও বায়ু দূষণ: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বাংলাদেশে দশ কোটিরও বেশি মানুষ আর্সেনিক দূষণের শিকার যা বিশ্বের জনস্বাস্থ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিষাক্ততার ঘটনা। অধিকন্তু, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৬ সালের প্রতিবেদন বলছে পারিপার্শ্বিক বায়ু দূষনের মানদন্ডে বাংলাদেশ বিশ্বের চতুর্থ দূষিত দেশ।
২. পুষ্টিগত সমস্যা: খাদ্যে লৌহের অভাবসহ অন্যান্য অনুপুষ্টির অভাব এখানে বিস্তৃত। একইসাথে পুষ্টির অভাব আর উদ্ভূত ওজনাধিক্যের সমস্যা অসংক্রামক রোগগুলোর পেছনে জটিল পটভূমি হিসেবে কাজ করে।
৩. ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ: অসংক্রামক রোগসমূহের জন্য দায়ী বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ বিপাকজনিত সমস্যার উদ্ভব ঘটায় (যেমন: অস্বাস্থ্যকর খাদ্যগ্রহণ, কায়িক শ্রমের অভাব, তামাক সেবন)। এগুলো হয় খুব সচরাচর দেখা যাচ্ছে বা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে অথবা দুটোই হতে পারে। পাশ্চাত্যের জীবনযাত্রা আমাদের আবহমান জীবনযাত্রার সাথে সমন্বিতভাবে অসংক্রামক রোগগুলোর ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
কেপেবল প্রকল্পটি ঠিক সেই সব আন্তঃসম্পর্কিত ঝুঁকি বা ফ্যাক্টরগুলো নিয়ে কাজ করে যেগুলোকে এর আগে কোন সামগ্রিক বা সমন্বিত প্রকল্পের আওতায় এনে বিশ্লেষণ করা হয়নি যেমন অসংক্রামক রোগগুলোর পেছনে থাকা সামাজিক, পরিবেশ ও আচরণগত ঝুঁকিসমূহ। এই ঝুঁকিগুলো গুচ্ছাকারে অবস্থান করে আরও বেশি খারাপ প্রভাব ফেলে, একটি আরেকটির নিয়ামক হিসেবে কাজ করে এবং এলাকাভেদে গ্রাম, শহর বা উপশহরে প্রায় একইভাবে বিস্তার লাভ করে। এই প্রকল্পটি বাংলাদেশে নতুন নতুন গবেষণার ক্ষেত্র তৈরি করবে এবং একাধিক সংস্থার সমন্বয়ে দুইটি (নির্মল বায়ু, পানি ও শৌচ ব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্য ও সুস্থতার উন্নয়ন) টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অর্জনে কাজ করবে ।
এই উদ্দেশ্যে কেপেবল ৪টি আন্তঃসম্পর্কিত লক্ষ্য ঠিক করেছে:
বাংলাদেশের জন্য ১,৫০,০০০ অংশগ্রহণকারীর সমন্বয়ে শহর, বস্তি ও গ্রামীণ প্রেক্ষাপটের উপযোগী একটি চিরস্থায়ী অসংক্রামক রোগ গবেষণা প্লাটফর্ম তৈরি করা
অসংক্রামক রোগগুলোর ঝুঁকিসমূহ চিহ্নিত করে সেগুলোর অন্তর্বর্তী প্রক্রিয়া অনুধাবন করার জন্য একটি আন্তঃবিভাগীয় গবেষণা কর্মসূচি পরিচালনা করা এবং সেগুলো প্রতিহত করার জন্য অনুশীলনযোগ্য, পরিমাপযোগ্য, সাশ্রয়ী ও গ্রহণযোগ্য কর্মসূচি প্রণয়ন করা
বাংলাদেশের গবেষণা সক্ষমতা বৃদ্ধি করা
বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের সর্বোত্তম কেন্দ্রগুলোর মাঝে অংশীদারিত্ব চলমান রেখে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করা
বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা পরিচালনা (বিলিভ স্টাডি)
বাংলাদেশে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, আইসিডিডিআরবি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ প্রয়াসে ৩টি বিশালাকারের জনগোষ্ঠী ভিত্তিক দীর্ঘমেয়াদি অনুস্মরণীয় গবেষণা পরিচালনা করছে। এই গবেষণার জন্য জনগোষ্ঠীর নির্বাচনের ক্ষেত্রে যাতে সর্বস্তরে এবং সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ অংশ নিতে পারে সে জন্য একই পরিবেশে বসবাসরত একই ধরনের জিনগত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী লোকদের মধ্যে ঘরে ঘরে জরিপ চালানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে ঢাকার মিরপুরের প্রায় ৫০,০০০ মানুষকে এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
দক্ষতা উন্নয়ন
আইইডিসিআর-এর সহযোগিতায় কেপেবল ৩টি আন্তসম্পর্কিত স্তরে দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করছে। সেগুলো হল ব্যক্তিগত, সাংগঠনিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়। প্রথম সংক্ষিপ্ত কোর্সটি
২০১৮-এর জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ৩০জন নবীন গবেষক অংশ নিয়েছিলেন। এর উদ্দেশ্য ছিল ১. অসংক্রামক রোগ গবেষণায় রোগতত্ত্ব, পরিসংখ্যান, এবং জনস্বাস্থ্য বিষয়ক সম্যক ধারণা দেয়া ২. অসংক্রামক রোগের সাথে সম্পর্কিত আচরণগত, পরিবেশগত ও সামাজিক বিষয় সম্পর্কে জানা এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য প্রশিক্ষণ ৩. অসংক্রামক রোগ বিষয়ে গবেষণার জন্য দীর্ঘ মেয়াদে গবেষক নির্বাচন।
পাঁচজন অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশ এবং যুক্তরাজ্যের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোতে গবেষণার জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। ভবিষ্যতের কোর্সগুলোতে আরো ৩০জন বা তারও বেশি নবীন গবেষকের মধ্যে থেকে আটজনকে নির্বাচিত করা হবে দীর্ঘ মেয়াদে গবেষণা পরিচালনার উদ্দেশ্যে এবং একটি নীতি নির্ধারণী কোর্সও পরিচালিত হবে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে অসংক্রামক রোগ মোকাবেলায় দক্ষতা অর্জনের জন্য।
কেপেবল, সাউথ সাউথ কোলাবরেশন একটি অতি পরিচিত নেটওয়ার্কেরও অংশ, যার উদ্দেশ্য হল অসংক্রামক রোগ মোকাবেলার জন্য এশিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাঝে সংযোগ স্থাপন করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের অধিবাসীদের জন্য উন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।