Wellcome to National Portal
Text size A A A
Color C C C C

সর্ব-শেষ হাল-নাগাদ: ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

বাংলাদেশে সংক্রামক রোগের বিশ্বমারী ঠেকানো ও মোকাবেলার প্রস্তুতি

          বাংলাদেশে সংক্রামক রোগের বিশ্বমারী ঠেকানো ও মোকাবেলার প্রস্তুতি

এম মুশতাক হোসেন, আইইডিসিআর

ভূমিকা

সংক্রামক ব্যধি সরাসরি বিশ্বমারী বা প্যানডেমিকে পরিণত হয় না। প্রথমে তা প্রাদুর্ভাব বা আউটব্রেক আকারে আত্মপ্রকাশ করে। সংক্রামক ব্যধি পূর্ব পরিচিত হতে পারে, আবার অজানাও হতে পারে। প্রাদুর্ভাব যদি গোটা দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং মানুষের অসুস্থতা এবং মৃত্যুর সংখ্যা ও হার যদি অন্য সময়ের তুলনায় তাৎপর্যপূর্ণভাবে বেশী হয় - তাহলে তাকে মহামারী বা এপিডেমিক বলা যেতে পারে। আর মহামারী যদি একাধিক মহাদেশে (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অঞ্চল বা রিজিওন) বিস্তৃত হয় তবে তাকে বিশ্বমারী বা প্যানডেমিক বলা যেতে পারে। মহামারী পরিস্থিতি ঘোষণা করার এখতিয়ার দেশীয় কর্তৃপক্ষের, আর বিশ্বমারী ঘোষণা করার এখতিয়ার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার। তবে এর আগের ধাপে কোনো অসুস্থতা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার হুমকি সৃষ্টি করেেল তাকে ”আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উদ্বেগজনক জনস্বাস্থ্যের জরুরী পরিস্থিতি” (পাবলিক হেলথ এমারজেন্সি অব ইন্টারন্যাশনাল কনসার্ন) বলে ঘোষণা করা হয়। যেমন মার্স-করোনা কিংবা ইবোলা রোগ দুটি জনস্বাস্থ্যের জন্য আন্তর্জাতিক জরুরী পরিস্থিতি বলা হয়েছে, কিন্তু প্যানেডেমিক বলা হয়নি। কিন্তু কোভিড-১৯ অতি দ্রুত এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। পশ্চিম  প্রশান্ত মহসাগরীয় অঞ্চল থেকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া (থাইল্যান্ড) হয়ে ইউরো অঞ্চলে (ইটালী) ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে প্যানডেমিক বা বিশ্বমারী ঘোষণা করে।

বিশ্বমারীর প্রাথমিক অবস্থায় রোগের প্রাদুর্ভাবকে জরুরী জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে। তবে জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি জরুরী হলেই তা মহামারী বা বিশ্বমারীতে পরিণত হবে এমন কোনো কথা নেই। মহামারীর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে জনস্বাস্থ্যের প্রতিটি জরুরী পরিস্থিতিকেই গুরুত্ব দিয়ে ব্যবস্থাপনা করতে হবে।

কোন পরিস্থিতিকে আমরা জনস্বাস্থ্যের জরুরী  অবস্থা বলবো?

যে অসুস্থতার মাত্রা ও ব্যপ্তি সমাজ ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার স্বাভাবিক ক্ষমতাকে অতিক্রম করে সে ধরণের পরিস্থিতিকে জরুরী পরিস্থিতি বলা যেতে পারে। অসুস্থতায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ও মৃত্যুর সংখ্যা যদি অস্বাভাাবিকভাবে বেড়ে যায়, সে ধরণের পরিস্থিতিকেই জনস্বাস্থ্যের জরুরী অবস্থা বলা যেতে পারে। তবে নতুন কোনো সংক্রামক ব্যধি যা ইতিমধ্যে অন্য কোনো দেশে বা দেশসমূহে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে ও অনেক মানুষকে অসুস্থ করতে বা মৃত্যু ঘটাতে সক্ষম, তা যদি নতুন কোন দেশে একটিও শনাক্ত হয় - সেটাও ঐ নতুন দেশের জন্য জনস্বাস্থ্যের জরুরী অবস্থা ও মহামারী বলে চিহ্নিত হয়।

ভবিষ্যৎ বিশ্বমারীর প্রস্তুতি ও মোকাবেলার পরিকল্পনা কি?

এ কথাটা এখন বহুল উচ্চারিত যে, কোভিড-১৯ বিশ্বমারীই শেষ বিশ্বমারী নয়। ২০০০ সাল থেকে ইনফ্লুয়েঞ্জার নতুন ধরণের ভাইরাস দ্বারা বিশ্বমারী ঘটতে পারে, এ আশংকা থেকে সারা বিশ্বে প্রস্তুতি নেবার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কাজ শুরু করে। ২০০৯ সালে নতুন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস এইচ১ এন১ প্যানডেমিক ০৯ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়লে একে বিশ্বমারী বলে ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। যদিও এ বিশ্বমারীতে মৃত্যুর সংখ্যা  মৌসুমী ইনফøুয়েঞ্জায় মৃত্যুর তুলনায় অস্বাভাবিক ছিল না। এর পরে সারা দুনিয়ায় বিশ্বমারী প্রস্তুতি কাজে এক ধরণের ঢিলেমী পেয়ে বসে। এ কাজে প্রয়োজনীয় মনোযোগ না দেয়ায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান ভবিষ্যৎ বিশ্বমারী প্রসঙ্গ এক প্রকার ভুলে যেতেই বসে। এ অবস্থায় ২০১৯ সালে কোভিড-১৯ এর আবির্ভাব অনেকটা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতই ছিল।

এখন বিশ্বের উচ্চ আয়ের দেশগুলো বলছে যে, বিশ্বমারী প্রস্তুতির জন্য যত টাকা খরচ হত, তার চেয়ে কয়েক হাজার/ লক্ষ গুণ ক্ষতি হয়েছে এ কোভিড-১৯ বিশ্বমারীতে। এবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক নিয়োজিত একটি স্বাধীন প্যানেল ২০২১এর জানুয়ারীতে পেশকৃত  প্রতিবেদনে বলেছে, সময় থাকতে অনাগত বিশ্বমারী প্রস্তুতি ও মোকাবেলার জন্য পর্যাপ্ত সম্পদ বিনিয়োগ করার জন্য। ২০২০এর সেপ্টেম্বরে  জি২০ গোষ্ঠীর বিশটি দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রীবৃন্দ ইতালীর রোমে মিলিত হয়ে যৌথ ঘোষণাতে বিশ্বব্যাপী সংহতির মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বিশ্বমারী মোকাবেলার অঙ্গীকার ঘোষণা করেছে।

জনস্বাস্থ্যের জরুরী অবস্থা বা বৃহত্তর পরিসরে মহামারী/ বিশ্বমারী মোকাবেলার কাজ শুধু ঘটনাকে মোকাবেলাই নয়, এর মধ্যে পড়ে প্রাদুর্ভাব শনাক্ত করা, একে প্রতিরোধ করা, মোকাবেলা করা, ছড়িয়ে পড়লে ক্ষয়ক্ষতি কমানো, মহামারী শেষে পুনরায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা - এ গোটা ব্যবস্থাটাই হচ্ছে প্রস্তুতির অন্তর্গত।

বিশ্বমারী প্রস্তুতির অংশ হিসেবে জরুরী জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বিধি ২০০৫ অনুযায়ী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে সক্ষম করে তোলার জন্য নির্দেশিকা জারী করেছে ও নিয়মিত পরিবীক্ষণ করছে। বাংলাদেশও সে যাত্রায় সামিল। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য প্রতিরক্ষার জন্য একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনার (ন্যাপস) খসড়া প্রস্তুত করে। এর মধ্যেই চলে এলো কোভিড-১৯ বিশ্বমারী। বিশ্বমারী প্রস্তুতির যতটুকু সক্ষমতা এদেশে হয়েছে তার ওপর ভিত্তি করেই বিশ্বমারী মোকাবেলার কাজ চলছে। পাশাপাশি ভবিষ্যৎ বিশ্বমারী বা তার পূর্বরূপ জরুরী জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি মোকাবেলা পরিকল্পনা তৈরীর কাজ এগিয়ে নেয়া প্রয়োজন।

যে মূলনীতি অনুসরণ করে এ ধরণের পরিকল্পনা করা দরকারঃ

এগুলো হচ্ছে - জনগণের মালিকানা, জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানা, বহুখাতভিত্তিক ও বহুপাক্ষিক সক্রিয় টেকসই অংশীদারিত্ব, নারী অধিকার ও মানবাধিকার, সমতা, প্রমাণভিত্তিক, স্বচ্ছতা, টেকসই, সহনশীলতা, সরকারী-বেসরকারী অংশীদারত্ব, অব্যাহত উৎকর্ষতা-সহযোগিতা-সমন্বয়। পরিকল্পনার শুরুতে কর্মকৌশল (স্ট্র্যাটেজি) নির্ধারণ করা গুরুত্বপূর্ণ।

সেগুলো হতে পারেঃ

(ক) সংক্রামক রোগের ঝুঁকিগুলো চিহ্নিত করা ও চিহ্নিতকরণের কাজটা সময় সময় হালনাগাদ রাখা

(১) ক্ষতিগ্রস্ত হবার ঝুঁকির ক্ষেত্রগুলো ও ঝুঁকিসমূহ বিশ্লেষণ

(২) সম্ভাব্য পরিস্থিতির চিত্র নিরূপন করা

(খ) এর ভিত্তিতেই কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা সময়ে সময়ে হালনাগাদ করণ

(১) সমস্যানির্দিষ্ট পরিকল্পনা (যেমন: নিপাহ, ডেঙ্গু)

(২) খাত ভিত্তিক পরিকল্পনা (যেমন: স্বাস্থ্য, প্রাণী)

(গ) জরুরী ভিত্তিতে ব্যবহারক্ষম প্রয়োজনীয় অর্থসম্পদ ও জনবল প্রস্তুত রাখা যেমন

(১) অর্থ সংস্থানের কাঠামো তৈরী রাখা

(২) ধারাবাহিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্মী বাহিনীর সক্ষমতা বজায় রাখা

(ঘ) নেতৃত্ব ও সমন্বয় ব্যবস্থা প্রস্তুত রাখা যেন জরুরী পরিস্থিতির উদ্ভব হলে কে কোন কাজটি করবে তা আগে থেকেই জানা থাকে

(১) সংশ্লিষ্ট আইনী কর্তৃপক্ষ সুচিহ্নিত করা

(২) এ জন্যে জরুরী কার্যক্রম পরিচালনা কেন্দ্র (ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার) প্রস্তুত রাখা

(৩) পরিচালনা কেন্দ্র থেকে মোকাবেলা কার্যক্রম সক্রিয়করণ

(৪) নেতৃত্বদানকারী ও সহায়ক মন্ত্রণালয়সমূহ, অংশীদার সংস্থাসমূহ ও ব্যক্তিবিশেষদের ভূমিকা নির্ধারণ করে রাখা

(ঙ) অত্যাবশ্যকীয় স্বাস্থ্যসেবা অব্যাহত রাখা

(১) সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতে সহায়তা করা

(২) স্বাস্থ্যসেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো চালু রাখতে সহায়তা করা

(৩) মা ও শিশু স্বাস্থ্যের জনস্বাস্থ্য কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে সহায়তা করা

(৪) জরুরী স্বাস্থ্যসেবা সার্বক্ষণিকভাবে চালু রাখতে সহায়তা করা

(চ) স্বাস্থ্যঝুঁকি অবহিতকরণ ও ঝুঁকি প্রশমনে জনসম্পৃক্ততা

(১) তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও তথ্য বিনিময়

(২) গণমাধ্যমের সাথে কাজ করা

(৩) তথ্য কেন্দ্র

এ পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে জরুরী জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতির উদ্ভব হলে (যা হঠাৎ করেই ঘটবে) তাকে বিদ্যমান সম্পদ দিয়েই কত দ্রুত  সামাল দেয়া যায় তা নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে দরকার হচ্ছে বার বার মহড়া দিয়ে প্রস্তুতি পরিকল্পনাকে হালনাগাদ করে রাখা, একটি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি মোকাবেলা শেষে তার অভিজ্ঞতা থেকে পরবর্তী জরুরী পরিস্থিতি ব্যবস্থাপনাকে আরো উন্নত করে তোলা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের রাজনৈতিক অঙ্গীকার।

শুধুমাত্র জাতীয় পর্যায়কে মাথায় রেখে এ পরিকল্পনা করলে তা পূর্ণাঙ্গ হবে না। জেলা-উপজেলা-নগর, পাহাড়-বন-চরাঞ্চল, ছিন্নমূল জনগোষ্ঠী প্রভৃতি ক্ষেত্রগুলো বিবেচনায় নিতে হবে - এক কথায় কাউকে পেছনে ফেলে রাখা যাবে না।

শেষ কথা 

দেশ তথা বিশ্বের অব্যাহত সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের প্রাণকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা। জরুরী জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি মোকাবেলা তথা শক্তিশালী জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সম্পদের যোগান ও ব্যবহার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ। কোভিড-১৯ বিশ্বমারী চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে যে, জনস্বাস্থ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে দেশের অর্থনীতি, সমাজ, রাজনীতি সবই নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে। জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকী সৃষ্টি হয় প্রধানতঃ সংক্রামক ব্যধি থেকেই। তাই প্রতিটি দেশকে সংক্রামক ব্যধি খুঁজে বের করার জন্য, তার বিস্তার ঠেকানোর জন্য ও তা ছড়িয়ে পড়লে (মহামারী শেষ পর্যন্ত ঠেকানো যায় না, তবে যত বিলম্বিত করা যাবে ততই প্রস্তুতি নেয়া যাবে) মোকাবেলা করে ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য সদা প্রস্তুত থাকতে হবে। মনে রাখা দরকার, এটা কোনো সাময়িক বা আপদকালীন অস্থায়ী ব্যবস্থা দিয়ে মোকাবেলা করা যাবে না। এজন্য দরকার একটা স্থায়ী ব্যবস্থা।