অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী, রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগ, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল এন্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউট
বিশ্বব্যাপী রোগের বিস্তার ও মৃত্যুহার বৃদ্ধির একটি বড় কারণ উচ্চ রক্তচাপ। প্রতি বছর ১ কোটি মৃত্যু এবং ২১.২ কোটি ডিজ্যাবিলিটি এডজাস্টেড জীবন-বর্ষ-এর কারণ উচ্চ রক্তচাপ।
উচ্চ রক্তচাপের অন্যতম ঝুঁকির বিষয় হল খাবারে উচ্চমাত্রায় লবণ গ্রহণ। যেসব গবেষণায় উচ্চ রক্তচাপের সাথে লবণ গ্রহণের সম্পর্ক থাকার প্রমাণ পাওয়া যায় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে রোগতাত্ত্বিক গবেষণা, বংশানুক্রমিক এবং প্রাণীদের উপর গবেষণা। মানুষের উপর পরিচালিত রোগতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা যায় লবণ গ্রহণ সরাসারি রক্তচাপের সাথে সম্পর্কিত এবং যে জনগোষ্ঠী অতিমাত্রায় লবণ গ্রহণ করে তাদের গড় রক্তচাপও বেশি। জনসাধারণের মধ্যে পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায় যে, যখন লবণ গ্রহণ কমানো হয় তখন মানুষের রক্তচাপ ও কমে আসে। ‘ইন্টারসল্ট’ গবেষণায় দেখা যায় বিশ্বে ৩২টি দেশে লবণ গ্রহণের গড় মাত্রা প্রতিদিন ৯.৯ গ্রাম। উন্নত দেশসমূহে লবণ গ্রহণের সচরাচর মাত্রা প্রতিদিন ৯-১২ গ্রাম। এর মধ্যে ৮০% লবণ আসে প্রক্রিয়াজাত খাবার থেকে। এশিয়া ও অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে খাবারে বেশিরভাগ লবণ যুক্ত হয় রান্নার সময়, সস ও স্বাদ-গন্ধ বর্ধক উপাদান ব্যবহারে। অল্পমাত্রায় সোডিয়াম লবণ প্রাকৃতিকভাবেই সকল অপ্রক্রিয়াজাত খাবারে বিদ্যমান, তবুও খাদ্য প্রক্রিয়াজাত করণের সময়, রান্নায় বা পাতে লবণ যোগ করা হয়।
লবণ গ্রহণ পরিমাপ
‘খাবারে লবণ গ্রহণ কমানো’ প্রকল্পের কার্যকারিতা বোঝার জন্য মানুষের লবণ গ্রহণের মাত্রা পরিমাপ করা জরুরি। পরিমাপের প্রচলিত পদ্ধতিসমূহ হল:
ক. যতটুকু খাবার খাওয়া হয়েছে তা ওজন করা
খ. কি কি খাবার খাওয়া হয় তা মনে রাখা
গ. খাবার গ্রহণের পূর্বে খাবারে লবণের উপাদান পরিমাপ করা
ঘ. প্রস্রাবে ২৪ ঘণ্টার সোডিয়ামের পরিমাণ পরিমাপ করা যেটি সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি (গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড মেথড) বলে বিবেচিত।
বাংলাদেশীদের লবণ গ্রহণ
বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপের রোগী অনেক- প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একাধিক ব্যক্তি উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। তাই বাংলাদেশে লবণ ব্যবহারের বিভিন্ন দিক ও ভবিষ্যত কার্যক্রম নির্ধারণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে এ সংক্রান্ত তথ্য খুবই কম। প্রস্রাবে সোডিয়ামের মাত্রা থেকে লবণ গ্রহণের মাত্রা পরিমাপের কিছু গবেষণার ফলাফল টেবিল-১-এ দেখুন।
লবণ গ্রহণ কতটুকু কমাতে হবে
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, লবণ গ্রহণের মাত্রা হওয়া উচিত প্রতিদিন ৫ গ্রামের কম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মেডিসিন ইন্সটিটিউটের মতে, প্রতিদিন ৩.৭৫ গ্রাম লবণ গ্রহণই যথেষ্ট, যদিও যুক্তরাজ্যের ‘কনসেনসাস অন সল্ট এন্ড হেলথ’ লবণ গ্রহণের মাত্রা কমিয়ে প্রতিদিন ৩ গ্রামে আনতে বলে যা এক তৃতীয়াংশ স্ট্রোক এবং এক চতুর্থাংশ হৃদরোগ কমিয়ে আনতে পারবে বলে আশা করা হয় ।
বাংলাদেশের মানুষের খাবারে লবণ গ্রহণ কমাতে কর্ম পরিকল্পনা নির্ধারণ
সাধারণ মানুষের মধ্যে লবণ গ্রহণমাত্রা ৩০% কমিয়ে আনা বৈশ্বিক লবণ হ্রাসকরণের লক্ষ্য এবং এটি ২০১৩-২০২০ মেয়াদি অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের বৈশ্বিক কর্মপরিকল্পনার মূল অংশ। সম্প্রতি অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে সরকারকর্তৃক গৃহীত বহুমাত্রিক কর্ম পরিকল্পনায়ও এই লক্ষ্য অর্জনের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। যদিও বাংলাদেশের মানুষের লবণ গ্রহণের মাত্রা জানা নেই, তবুও যদি আমরা ২০১৩-এর হিসাব অনুযায়ী প্রতিদিন ১১ গ্রাম লবণ গ্রহণ করে থাকি তবে ২০২০ সালের মধ্যে তা কমিয়ে ৭.৭ গ্রাম লক্ষ্য করতে হবে (যা বর্তমান অবস্থা থেকে ৩০% কম)।
মানুষের মধ্যে লবণ গ্রহণের মাত্রা কমানোর লক্ষ্যে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা কিছু সাধারণ জ্ঞান এবং গবেষণা লব্ধ জ্ঞানের সমন্বয়ে একটি বিশেষ কর্মপরিকল্পনা (`SHAKE’ Package) গ্রহণ করেছে । এতে অন্তর্ভূক্ত আছে
নজরদারি: লবণ ব্যবহার পরিমাপ ও তদারকি করা
খাদ্য প্রস্তুতকারী উৎসে নিয়ন্ত্রণ: অল্প লবণ ব্যবহার করে খাদ্য প্রস্তুত প্রণালী উৎসাহিত করা
মোড়ক ও বাজারজাত করণে মানদন্ড অবলম্বন: খাদ্য বাজারজাত করার সময় মোড়কের গায়ে এর উপাদান/গুণাগুণ বর্ণনার ক্ষেত্রে মানদন্ড মেনে চলা
তথ্য সচেতনতা: তথ্য ও সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যে লবণের মাত্রা কমাতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা
পরিবেশ: স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণে সহায়ক পরিবেশ তৈরি
বাংলাদেশে লবণ গ্রহণ সংক্রান্ত নীতিমালার অভাব রয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদ (বিএনএনসি) কর্তৃক প্রণীত খাদ্যাভ্যাস নির্দেশিকায় লবণ গ্রহণ কমানোর ওপর জোর দেয়া আছে। উক্ত নির্দেশিকায় রান্নায় আয়োডিনযুক্ত লবণের ব্যবহার, বেশিমাত্রায় লবণ ও লবণযুক্ত খাবার পরিহার এবং প্রতিদিন লবণ গ্রহণ ৫-১০ গ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
তথাপি, বাংলাদেশে কিছু নীতিমালা ও কার্যক্রম প্রয়োজন যার মধ্যে খাদ্য জরিপের মাধ্যমে লবণ গ্রহণের পরিমাণ, লবণে আয়োডিন যুক্তকরণের আইন, প্রক্রিয়াজাত খাবারে লবণের পরিমাণ ইত্যাদি সন্নিবেশিত করা থাকবে।
সাধারণ জনগণের কি পরিমাণ লবণ গ্রহণ করা উচিত সে বিষয়েও সরকারের পক্ষ থেকে দিক নির্দেশনা দেয়া ও সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন।
অভ্যন্তরীণ খাদ্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও রেস্তোরাঁসমূহকেও এ বিষয়ে সজাগ করতে হবে। এনজিও এবং সুশীল সমাজকে লবণ গ্রহণ কমানোর লক্ষ্যে এগিয়ে আসতে হবে।
বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানকেও জনসমাজে ও কর্মস্থলে রক্তসংবহনতন্ত্রের রোগ নিরসনে প্রয়োজনীয় কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে ।