Wellcome to National Portal
Text size A A A
Color C C C C

সর্ব-শেষ হাল-নাগাদ: ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

অসংক্রামক রোগ ও তার প্রতিরোধ: বৈশ্বিক, আঞ্চলিক এবং বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট

অধ্যাপক ডা. এম এস এ মানসুর আহমেদ, নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সাইন্সেস

 

 

বিশ্বজুড়ে অসংক্রামক রোগ

সারাবিশ্বে প্রধান অসংক্রামক রোগগুলোর মধ্যে রয়েছে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, দীর্ঘমেয়াদী শ্বাসতন্ত্রের রোগ, ক্যান্সার এবং মানসিক সমস্যা। বিশ্বের ৮০% অকাল মৃত্যু ঘটে এই রোগগুলোর কারণে। প্রাক্কলিত হিসেব অনুযায়ী প্রতি বছর প্রায় ৪ কোটি লোক অসংক্রামক রোগের কারণে মারা যায় যা বিশ্বের মোট মৃত্যুর ৭১%। বয়স বাড়ার সাথে সাথে অসংক্রামক রোগজনিত মৃত্যুর হার বাড়ে। প্রতি বছর ৩০-৬৯ বছর বয়সী দেড় কোটি লোক অসংক্রামক রোগে মারা যাচ্ছে; এই অকালমৃত্যুর ৮৫% ঘটে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে ২০২০ সাল নাগাদ বিশ্বের মোট রোগের ৮০%-ই হবে এই অসংক্রামক রোগ। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রতি দশটি মৃত্যুর মাঝে সাতটির কারণ হবে অসংক্রামক রোগ, যার প্রায় অর্ধেক মৃত্যু ঘটবে ৭০ বছর পূর্ণ হবার আগেই। এশিয়ার মোট মৃত্যুর প্রায় অর্ধেকের কারণ অসংক্রামক রোগ। ৮০ শতাংশের বেশি হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসজনিত মৃত্যু, ৯০% দীর্ঘমেয়াদী শ্বাসরোগে মৃত্যু এবং দুই-তৃতীয়াংশ ক্যান্সারজনিত মৃত্যু ঘটে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। বিশ্বের অন্য যেকোন অঞ্চলের তুলনায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অসংক্রামক রোগ বৃদ্ধির হার সবচেয়ে দ্রুত। যেখানে ১৯৯০ সালে এই হার ছিল মাত্র ৪০% তা এখন (২০১৪) বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০-৭০%-এ।

বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগের চিত্র

রোগ ও প্রতিবন্ধকতার কারণে বাংলাদেশে কর্মক্ষমতা হ্রাসের হিসেবে অসংক্রামক রোগ ৬১ শতাংশ দায়ী। ২০১০ সালে পরিচালিত অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি সংক্রান্ত একটি জরিপে দেখা যায় ৯৯% মানুষের অন্তত একটি এবং প্রায় ২৯% মানুষের তিনটিরও বেশি অসংক্রামক রোগের কারণ রয়েছে।

২০৫০ সালে বাংলাদেশে ষাটোর্ধ্ব লোকের সংখ্যা হবে মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ (২১.৮ কোটি) যারা নির্ভরশীল জনসংখ্যা এবং অসংক্রামক রোগের বোঝা বাড়াবে।

বাংলাদেশের পাঁচটি মূল অসংক্রামক রোগের অবস্থা বর্ণনা করা হলো:

১. রক্তসংবহনতন্ত্রের রোগ

রক্তসংবহনতন্ত্রের (সিভিডি) রোগ, বিশেষ করে করোনারি আর্টারি ডিজিজ ধীরে ধীরে মহামারীর রূপ নিচ্ছে। পাশাপাশি উচ্চ রক্তচাপ ও হার্ট ফেইলিউরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে বাতজ্বরের হার কমছে। তবে বলা চলে বর্তমানে এ সংক্রান্ত নির্ভরযোগ্য তথ্য আসলে অপ্রতুল।

২০১৮ সালের একটি গবেষণা বলছে হৃদরোগের ধরন, লিঙ্গ, ভৌগলিক অবস্থা নির্বিশেষে এর হার ৫%। শহরাঞ্চলে এই হার গ্রামাঞ্চলের চেয়ে বেশি। এইসব রক্তসংবহনতন্ত্রের রোগের মাঝে সর্বাধিক হলো হৃদযন্ত্রের রোগ (২১%) এবং সবচেয়ে কম হলো মস্তিষ্কের স্ট্রোক (১%)।

‘উচ্চ রক্তচাপ’ অসংক্রামক রোগগুলোর মাঝে প্রধান যা শহরাঞ্চলে বেশি। ২০১১ সালের এক গবেষণা বলছে সার্বিকভাবে উচ্চ রক্তচাপের হার ২৬.৪% যা মহিলাদের মাঝে (৩২.৪%) পুরুষদের (২০.৩%) তুলনায় বেশি। এই গবেষণায় আরও জানা যায় বেশি ওজন এবং ডায়াবেটিসের উপস্থিতি উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।

জন্মগত হৃদরোগের হার সম্পর্কে বাংলাদেশে তথ্য ও উপাত্ত সীমিত।

২. ডায়াবেটিস

বাংলাদেশে সব বয়সী মানুষের মাঝে ডায়াবেটিস রোগের হার বাড়ছে। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন (আইডিএফ)-এর হিসেবে ২০১৭ সালে বাংলাদেশে ৬৯,২৬,৩০০ ডায়াবেটিস রোগী চিহ্নিত হয়েছে এবং বয়স্কদের মাঝে এর হার ৬.৯%। প্রাপ্ত গবেষণা বলছে ওজনাধিক্য, স্থূলতা এবং উচ্চ রক্তচাপ টাইপ-২ ডায়াবেটিসের সাথে উল্লেখযোগ্যভাবে সম্পৃক্ত।

২০১৪ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায় যে, বয়সের সাথে সামঞ্জস্য করার পর, নারীপুরুষ নির্বিশেষে ডায়াবেটিস ও প্রাক-ডায়াবেটিসের হার যথাক্রমে ৯.৭% এবং ২২.৪%।

৩. দীর্ঘমেয়াদী শ্বাসতন্ত্রের রোগ

প্রায় দুই তৃতীয়াংশ রোগী জানতেই পারেন না যে তারা অনিরাময়যোগ্য ফুসফুসের সমস্যায় ভুগছেন। এই রোগের হার গ্রামাঞ্চলের মানুষের মাঝে শহুরে মানুষদের চেয়ে বেশি দেখা যায়। গোবর/ঘুঁটে/লাকড়ি, এইসব জ্বালানীর ব্যবহার এবং ধূমপান এই দীর্ঘমেয়াদী শ্বাসতন্ত্রের রোগের সাথে সম্পর্কিত। ২০১৫ সালের এক গবেষণায় দেখা যায় এই রোগের হার ১৩.৫% (গ্লোবাল ইনিসিয়েটিভ ফর লাং ডিজিজেস নির্ণায়ঙ্ক অনুযায়ী) অথবা ১০.৩% (লোয়ার লিমিট অফ নরমাল নির্ণায়ঙ্ক অনুযায়ী)।

৪. ক্যান্সার

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেবে বাংলাদেশে মৃত্যুর ষষ্ঠতম কারণ ক্যান্সার। পুরুষদের মাঝে ফুসফুস ও মুখের এবং নারীদের মাঝে স্তন ও জরায়ু মুখের ক্যান্সার বেশি দেখা যায়।

জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের একটি সমীক্ষায় দেখা যায় যে, ২০১৫ সালে বহির্বিভাগের মোট রোগীর সংখ্যা ছিল ১,৭৪,০৩৭ এবং ভর্তিকৃত রোগীর সংখ্যা ছিল ৭২৮৫। ভর্তিকৃত ১৯৪২ জন আন্ত্রিক (খাদ্যনালী) ক্যান্সার রোগীর মধ্যে ১৫.৩% পায়ুপথ ও ৭.১% পয়নালীর ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিল।

৫. মানসিক সমস্যা

২০১৪ সালে গবেষণা সমীক্ষাদির বিশদ বিশ্লেষণ থেকে জানা যায় বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মানসিক সমস্যার হার ৬.৫%-৩১% এবং শিশুদের ১৩.৪% থেকে ২২.৯%। ২০১৬ সালের একটি তথ্যমতে বাংলাদেশে বিষণœতাজনিত সমস্যা শতকরা ৪.৪।

অসংক্রামক রোগের কারণসমূহ

চারটি বিপাকজনিত ঝুঁকিকে অসংক্রামক রোগ বৃদ্ধির মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এগুলো হলো উচ্চ রক্তচাপ, ওজনাধিক্য বা স্থূলতা, রক্তে অতিরিক্ত চিনি এবং অতিরিক্ত চর্বির উপস্থিতি।

অনেকগুলো কারণ আচরণগত ও পরিবর্তনযোগ্য, যেমন, তামাকের ব্যবহার, কায়িক পরিশ্রমের অভাব, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, মদ্যপান ইত্যাদি।

বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ

অসংক্রামক রোগের ঝুঁকিসমূহ কমাতে হলে এটিকে সামগ্রিকভাবে মোকাবেলা করতে হবে, যার মধ্যে স্বাস্থ্য ছাড়াও অর্থ, যোগাযোগ, শিক্ষা, কৃষি, পরিকল্পনা ও অন্যান্য খাতকেও সম্পৃক্ত করতে হবে। ব্যবস্থাপনার আওতায় রোগ নির্ণয়, স্ক্রিনিং, চিকিৎসা এবং উপশমক যত্নকে নিয়ে আসতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় ও সময়োপযোগী চিকিৎসা- অসংক্রামক রোগ কমাবার অন্যতম উপায় হতে পারে এবং সেটা প্রাইমারি হেলথ কেয়ার এর মাধ্যমেই সম্ভব। আমাদের লক্ষ্য হবে ২০২৫ সালের মধ্যে অসংক্রামক রোগের কারণে অকাল মৃত্যুহার ২৫% কমিয়ে আনা এবং ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অর্জন করা যেখানে বলা হয়েছে অকাল মৃত্যুহার এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনতে হবে। বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসার জন্য এখন যেটি প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে, বর্তমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং যে সকল দূর্বলতা আছে সেগুলো সমাধানের জন্য কৌশল নির্ধারণ করা।